ইতিহাস (ছোটগল্প)

ইতিহাস নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত একটি বিখ্যাত ছোটগল্প। এই গল্পের প্রথম প্রকাশকাল ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাস।[1] সমসাময়িক সময়ের এক তিমিরাচ্ছন্ন এবং পারস্পরিক যুযুধান সামাজিক পটভূমিকায় রচিত এই ছোটগল্পে শেষপর্যন্ত প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন মানুষকে এসে দাঁড়াতে হয় পাশাপাশি; বেঁচে থাকার সংগ্রামের বৃহত্তর প্রয়োজনে ক্ষুদ্রতর বিরোধ হারায় তার প্রাসঙ্গিকতা। ইতিহাসের এই শিক্ষাকে সামনে রেখেই গল্পটি পৌঁছায় তার উপসংহারে।

ইতিহাস
কোলকাতার মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সের পক্ষ থেকে ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে (১৯৫২ খ্রিঃ) প্রকাশিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলীর প্রচ্ছদ। এই রচনাবলীর ৩য় খণ্ডের ৪৯৪ পৃষ্ঠায় "ইতিহাস" গল্পটি মূদ্রিত রয়েছে।
লেখকনারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
মূল শিরোনামইতিহাস
দেশভারত
ভাষাবাংলা
ধরনছোটগল্প
প্রকাশিতঅক্টোবর, ১৯৪৩
প্রকাশকএম সি সরকার
মিডিয়া ধরনছাপা

গল্পটি পরবর্তীকালে তাঁর ভোগবতী (১৯৪৭) ছোটগল্প সংকলন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।[2]

প্রকাশনার ইতিহাস

রসায়ন-প্রতিষ্ঠান ক্যালকাটা কেমিক্যাল দেশের সুখ্যাত গল্পকারদের কাছ থেকে লেখা গল্প নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করতে চাইলে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ইতিহাস গল্পটি প্রেরণ করেন। গল্পটি পুরস্কৃত হয় ও পাঠকদের বিচারেও সেরার সম্মান পায়।[2] পরে ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে এম সি সরকার প্রকাশনা সংস্থা কথাশিল্প নাম দিয়ে একটি সংকলনে গল্পগুলি প্রকাশ করলে, তাতেও এই গল্পটিই ছিল প্রথম গল্প। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখানে প্রকাশিত অন্যান্য গল্পগুলির গল্পকার ছিলেন আশাপূর্ণা দেবী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্য্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রমুখ প্রখ্যাত সাহিত্যিকবৃন্দ।[1]

চরিত্র

গল্পটির মুখ্য চরিত্র তিনজন -

  • অমরেশবাবু, অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক, বিপত্নীক
  • প্রণতি, তাঁর মেয়ে
  • লোকেশ, তাঁর ছেলে।

কিন্তু এঁরা ছাড়াও আরও কয়েকটি তুলনায় অপ্রধান চরিত্র এই গল্পের অঙ্গাঙ্গী অঙ্গ, যেমন -

  • নিতাই
  • দারোগা
  • দারোগার স্ত্রী ও শিশুপুত্র।

কাহিনী

অমরেশবাবু একজন অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার। তিনি গৌড়বঙ্গের ইতিহাসের গবেষণায় রত। সময় ১৯৪২ সালের আগস্ট মাস, স্থান অগ্নিগর্ভ তমলুক। তাঁর ছেলে লোকেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ, অপরদিকে মেয়ে প্রণতি মূলত ঘরকন্যা নিয়েই ব্যস্ত। দেশের জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে এমনকী প্রাণ উৎসর্গ করতেও লোকেশ সদা উন্মুখ, অপরদিকে প্রণতির দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিকতা থেকে সে উন্মাদনার মানে বোঝা ভার। থানায় বিক্ষোভ চলাকালীন গুলি চললে লোকেশের মৃত্যু ঘটে। বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। কিন্তু এক প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের রাতে বন্যায় সবকিছু ভেসে যাবার উপক্রম হলে ঘরহারা, অসহায় অসংখ্য মানুষের সাথে লোকেশের হত্যাকারী দারোগাও তার স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে সাথে নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে হাজির হয় অমরেশেরই বাড়িতে। তাকে চিনতে পেরে ফুঁসে ওঠে নিতাই, লোকেশের শেষমুহূর্তের সাথী। কিন্তু প্রণতি আশ্রয় দেয় দারোগার স্ত্রীকে; শিশুপুত্রটির পাছে ক্ষতি হয় তাই তাকে শুকনো কাপড়ের জোগান দেয়। ঠিক সেই সময়েই অমরেশবাবু শেষ করেন তাঁর ইতিহাসের শেষ অধ্যায়-

"যাহারা পরস্পরের বুকে আজ আঘাত হানিতেছে - মোহে অন্ধ হইয়া, স্বার্থে আত্মবিস্মৃত হইয়া - সেদিন সর্বগ্রাসী মৃত্যুর হাত হইতে নিজেদের বাঁচাইতে গিয়া তাহাদের হাতে হাতে রাখী বাঁধিতে হইবে। দেশে দেশে ইতিহাসের ইহাই শিক্ষা।"[3][4]

গল্পকথন

ইতিহাস ছোটগল্পটির গল্পকথনের (narration) মধ্যে একই সাথে দুটি ভিন্নমুখী অভিমুখ কাজ করে। একদিকে থাকে মুখ্য গল্পকথক, নিজে গল্পের বাইরে অবস্থান করে এক আশ্চর্য নির্লিপ্ত নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে সে বলে চলে গল্পটি। অমরেশবাবু যখন অষ্টম শতাব্দীর ইতিহাস লেখায় মনোনিবেশ করেন তখন তাঁর দৃষ্টির সেই ঐতিহাসিকসুলভ নির্লিপ্ততা গল্প যত এগোয়, কোনও এক বিন্দুতে এসে যেন মিলে যায় সেই মুখ্য গল্পকথকের বলে চলা গল্পেরই সাথে। সমসাময়িক সময়ের বিভিন্ন সংঘাত, ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিকোণ, এমনকী ঘটমান বর্তমানও - সব কিছুই যেন তার সেই নির্লিপ্ততার সামনে এসে পড়ে হারিয়ে ফেলে তাদের তীব্রতা, সর্বগ্রাসিতা, হয়ে ওঠে এক বৃহত্তর ইতিহাসেরই অঙ্গমাত্র। অপরদিকে আমরা পাই প্রণতি, লোকেশ, নিতাই - আর তাদের দৈনন্দিকতা, কথোপকথন, পারস্পরিক স্নেহ-মায়া-মমতা, বিরোধ, মতানৈক্য নিয়ে একেবারে দৈনন্দিন এক জগৎ, যেখানে প্রণতি, লোকেশ, প্রভৃতি চরিত্র হয়ে ওঠে পাঠকের কাছের মানুষ। তাদের দুঃখে আমরা কষ্ট পাই, লোকেশের মৃত্যুতে তীব্র আক্রোশ আমাদের মধ্যেও দানা বেঁধে ওঠে। কিন্তু ঠিক যেখানে এসে সেই আক্রোশ তীব্রতর হয়ে ওঠার কথা, ঠিক সেইখানেই মুখ্য কথনের নির্লিপ্ততা এসে জাগিয়ে তোলে আমাদের বৃহত্তর এক অনুভূতিকে; তুলে ধরে ইতিহাসের শিক্ষা - জীবন যখন আক্রান্ত হয়, অন্য সব দ্বন্দ্ব্ব-সংঘাতই তখন হয়ে দাঁড়ায় গৌণ, বাঁচার তাগিদে তখন পরস্পর বিবাদমনা শত্রুরাও পরস্পরের প্রতি বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। এটাই মানবসভ্যতার ইতিহাস।

তথ্যসূত্র

  1. ঘোষ, বারিদবরণ. "প্রাসঙ্গিক". বাছাই গল্প: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়. সম্পা. বারিদবরণ ঘোষ. কোলকাতা: মণ্ডল বুক হাউস, ২০০০। পৃঃ ৫ - ৮
  2. আশা দেবী ও অরিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়. "ভূমিকা".নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী.৩য় খণ্ড. কোলকাতা: মিত্র ও ঘোষ, ১৩৫৯ (১৯৫২ খ্রিঃ)।
  3. "ইতিহাস". বাছাই গল্প: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়. সম্পা. বারিদবরণ ঘোষ. কোলকাতা: মণ্ডল বুক হাউস, ২০০০। পৃঃ ২০ - ৩২
  4. "ইতিহাস". নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী.৩য় খণ্ড. কোলকাতা: মিত্র ও ঘোষ, ১৩৫৯ (১৯৫২ খ্রিঃ)। পৃঃ ৪৯৪ - ৫০৮
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.