ইক্ষ্বাকু
ইক্ষ্বাকু, শ্রাদ্ধদেব বৈবস্বত মনুর অন্যতম পুত্র। মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণে বলা হয়েছে যে,বৈবস্বত মনু সুদীর্ঘকাল পুত্রহীন ছিলেন। অবশেষে অপত্যলাভের জন্য যুগল দেবতা মিত্র-বরুণের উদ্দেশ্যে বিশাল যজ্ঞ করেন, এই যজ্ঞের পুরোহিত ছিলেন মহর্ষি বশিষ্ঠ। অতঃপর ভগবান শ্রীহরির আশির্বাদে এবং অবশ্যই যজ্ঞের ফলে বৈবস্বাত মনুর দশজন বিখ্যাত পুত্রের জন্ম হয়। তার মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন ইক্ষ্বাকু। অন্যান্য পুত্ররা হলেন ধৃষ্ট , শর্যাতি, নরিষ্যান্তি, নাভাগ, পৃষধ, করুষ, প্রাংশু, নৃগ, নেদিষ্ট। [1][2] মৎস্যপুরাণ মতে, ইল(জ্যেষ্ঠ), ইক্ষ্বাকু, কুশনাভ, অরিষ্ঠ, ধৃষঠ, শর্যাতি, নাভাগ, নেদিষ্ট, নৃগ, নরিষ্যন্তি [3]
..বিবস্বতো মনুঃ,মনোরিক্ষ্বাকুনৃগ- ধৃষ্ট- শর্যাতি-নরিষ্যন্তি- প্রাংশু- নাভাগনেদিষ্ট- করুষ- পৃষধ্রাখ্যাঃ পুত্রা বভূবঃ।
বলা হয়ে থাকে যে,বৈবস্বত মনুর ক্ষ্বব থেকে জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর নাম ইক্ষ্বাকু।[4]
ক্ষুবতশ্চ মনোরিক্ষ্বাকুর্ঘ্রাণতঃ পুত্র জজ্ঞে।
পুরাণসমুহে বর্ণিত হয়েছে যে, ইক্ষ্বাকু শতপুত্রের জনক ছিলেন। এদের মধ্যে বিকুক্ষি জ্যেষ্ঠ। বিকুক্ষি, নিমি, দণ্ড-এঁরা ইক্ষ্বাকুর তিনজন বিখ্যাত পুত্র।
সূর্যবংশের আদিপুরুষ মহারাজ ইক্ষ্বাকু। বিবস্বান্ সূর্যের পুত্র বৈবস্বত মনু। তাঁর পুত্র ইক্ষ্বাকু। ইক্ষ্বাকুর বংশধারায় বহু রাজ-রাজর্ষির জন্ম হয়। ইক্ষ্বাকু সূর্যের নাতি বলে তাঁর বংশকে সূর্যবংশ এবং ইক্ষ্বাকুর নিজের নামে তাঁর বংশ ইক্ষ্বাকুবংশ নামে বিখ্যাত। ককুৎস্থ, কুবলাশ্ব, যুবনাশ্ব, শ্রাবস্ত, মান্ধাতা, পুরুকুৎসু, অম্বরীশ, ত্রসদস্যু, অনরণ্য, হর্য্যশ্ব, সত্যব্রত ত্রিশঙ্কু, সৌদাস কল্মাসপাদ, রাজা হরিশ্চন্দ্র, সগর, ভগীরথ, রঘু, অজ, দশরথ এবং ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্র-প্রমুখ রাজ-রাজর্ষিগণ মহারাজ ইক্ষ্বাকুর বংশে জন্মগ্রহণ করেন।[5]
ইক্ষ্বাকু ন্যায়পরায়ণ ও ধার্মিক রাজা ছিলেন।এবং সেইসাথে তিনি পরমজ্ঞানী ব্রহ্মজ্ঞ ছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় জ্ঞানযোগ অধ্যায়ের সূচনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, 'আমি প্রথমে এই নিশ্চিত ফলজনক জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ সূর্যের নিকট বলেছিলাম, সূর্য তাঁর পুত্র বৈবস্বত মনুর নিকট বলেছিলেন এবং বৈবস্বত তাঁর পুত্র ইক্ষ্বাকুর নিকট তা বলেছিলেন'।[6] আবার মহাভারতের শান্তিপর্বে পিতামহ ভীষ্ম,যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, 'বিধি-মন্ত্র- উপনিষদ ও ধর্ম এ-সকল বিষয় শ্রীনারায়ণের থেকে ব্রহ্মা ক্রমে সূর্য,বৈবস্বত এবং তাঁর থেকে ইক্ষ্বাকু এই সকল বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন'।[7]
ভাগবত পুরাণের দ্বিতীয় স্কন্ধের একটি অধ্যায়ে ভগবান শ্রীহরির স্বরূপতাকে সম্যকরূপে জানেন এমন সব প্রাচীন রাজর্ষিদের নাম উল্লিখিত আছে। এদের মধ্যে ইক্ষাকু একজন।[5][8]
বৈবস্বত মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু্ই সর্বপ্রথম অযোধ্যায় রাজধানী স্থাপন করেন। রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে ইক্ষ্বাকুকে সম্পূর্ণ পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি বলা হয়েছে। ইক্ষ্বাকুর পুত্র বিকুক্ষি-ই অযোধ্যায় ইক্ষ্বাকুবংশ সুর্যবংশের মূল ধারার বাহক ছিলেন। একদিন ইক্ষ্বাকু অষ্টকাশ্রাদ্ধ উপলক্ষে বিকুক্ষিকে মাংস আনবার জন্য আদেশ দেন। বিকুক্ষি 'যথা আজ্ঞা' বলে বনগমন করে অনেক হরিণ, খরগোশ ও অন্যান্য প্রাণী বধ করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ক্ষুধার্থ ও ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তখন তিনি সেই বধিত প্রাণীগুলো থেকে একটি খরগোশ খেয়ে ফেললেন। তারপর ক্লান্তি দুর হলে রাজধানীতে এসে বধিত প্রাণীগুলো পিতাকে প্রদান করলেন। রাজা ইক্ষ্বাকু সেই প্রাণীগুলো কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের নিকট প্রেরণ করলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ সেগুলো দেখে বললেন, 'এই মাংসে কোনো প্রয়োজন নেই। এ মাংস অপবিত্র। রাজা! তোমার পুত্র এই সকল প্রাণী থেকে একটি খরগোশ ভক্ষণ করেছে। 'দেবতার উদ্দেশ্যে সমর্পিত মাংস। যজ্ঞ আরম্ভের পূর্বেই তা অপবিত্র হয়েছে। মহারাজ ইক্ষ্বাকু তখনই পুত্রকে ডেকে ভর্ৎসনা করলেন এবং রাজ্য থেকে বিতাড়িত করলেন। এর পরে মহারাজ ইক্ষ্বাকু স্বর্গত হলে বিকুক্ষি-ই অযোধ্যার সিংহাসনে বসেন।[9][10]
ইক্ষ্বাকুর অপর পুত্র নিমি মিথিলার রাজা ছিলেন। এই নিমি-র বংশপরম্পরায় মহাজ্ঞানী, আত্মজ্ঞানী ব্রহ্মজ্ঞ 'জনক' উপাধীধারী রাজারা মিথিলায় রাজত্ব করতেন। এই বংশেরই সীরধ্বজ জনক লাঙল দিয়ে জমি চাষ করবার সময় দেবী লক্ষীর অংশসম্ভূত সীতাকে কন্যারূপে লাভ করেন।[11][12]
মহারাজ ইক্ষ্বাকুর পুত্র দণ্ড অত্যন্ত মূঢ় ও মূর্খ ছিল।কারও কথা শুনত না। এই কারণে ইক্ষাকু ভাবতেন যে তাঁর পুত্র ভবিষ্যতে নিশ্চয় দণ্ড প্রাপ্ত হবে। এই কারণে তার নামও রাখলেন দণ্ড এবং তাকে বিন্ধ্য ও ঋক্ষ পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে রাজ্য প্রদান করেন। ঐ স্থানে দণ্ড মধুমন্ত নামে নগরী স্থাপন করে শুক্রাচার্যকে পৌরহিত্যে বরণ রাজ্যশাসন করতেন।[13]
রামায়ণের আদিকাণ্ডে এরকম বর্ণনা আছে যে, মহারাজ ইক্ষ্বাকু-র অলম্বুষা নামের পত্নীর গর্ভে বিশাল নামে এক পরম ধার্মিক পুত্র জন্মে। তিনি বিশালা নামক এক নগরী স্থাপন করেন।[14]
মহাভারতের শান্তিপর্বের অন্তর্গত খড়্গৎপত্তি উপাখ্যানে বর্ণিত যে, প্রাচীনকালে ব্রহ্মা দুষ্টের দমনের জন্য যে তরবারি নির্মাণ করেন তা বৈবস্বাত মনুর পরম্পরায় ইক্ষ্বাকুর হাতে আসে এবং এবং ইক্ষ্বাকুর থেকে রাজা পুরূরবা সেই তরবারি লাভ করেন।[15]
মহাভারতের আদিপর্বের সূচনায় ইক্ষ্বাকুর নাম উল্লিখিত হয়েছে অন্যতম প্রাচীন রাজর্ষি হিসেবে। পুত্রশোকাতুর ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা দেবার সময় সঞ্জয় বহু প্রাচীন রাজর্ষিদের নাম উল্লেখ করেছেন যারা দীর্ঘকাল যাবৎ বিশাল সাম্রাজ্য এবং অতুল ঐশ্বর্য ভোগ করে সময়ের অলঙ্ঘনীয় নিয়মে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ইক্ষ্বাকু একজন।[5][16]
তথ্যসূত্র
- হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। রাজা ! প্রজাপতি মনুর ইক্ষ্বাকু নামে এক পুত্র হইয়াছিল....।অনুশাসন পর্ব,অধ্যায়_২,শ্লোক_৫-৬।
- শ্রীরামনারায়ণ বিদ্যারত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ। শুকদেব কহিলেন,বিবস্বনের পুত্র শ্রাদ্ধদেব নামে বিখ্যাত সপ্ত মনু,যিনি বর্ত্তমান তাহার সন্তানদিগের বিবরণ বলিতেছি শ্রবণ কর।৮ম স্কন্ধ,অধ্যায়_১৩,শ্লোক_১।
- পঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত,, মৎস্যপুরাণম্। বৈবস্বত মনুর দশ পুত্র।সকল পুত্রই মহাবল।অধ্যায়_১১,শ্লোক_৪০-৪১।
- পঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, বিষ্ণুপুরাণম্ , আর্য্যশাস্ত্র। ব্রহ্মার দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ হইতে প্রজাপতি দক্ষ জন্মগ্রহণ করেন..।চতুর্থাংশ,প্রথম অধ্যায়,শ্লোক_৫।
- নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সম্পাদিত, পুরাণকোষ। ইক্ষ্বাকু।
- মহর্ষি কৃষ্ণদৈপায়ন বেদব্যাসকৃত, শ্রীমদ্ভাগবত গীতা। ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্।বিবস্বান মনবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবে'ব্রবীৎ।অধ্যায়_৪,শ্লোক_১।
- হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। তাহার পর ত্রেতাযুগ প্রারম্ভে বিবস্বান আপন পুত্র বৈবস্বাত মনুকে এই ধর্ম দান করেন।শান্তিপর্ব,অধ্যায়_৩৩২,শ্লোক_৫১-৫২।
- শ্রীরামনারায়ণ বিদ্যারত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ। হে নারদ ! ভগবানের মায়ার অন্ত দুর্জ্ঞেয় বটে,কিন্তু তাঁহার কৃপায় 'এটাই মায়া' এরূপ জ্ঞান অনেকেরই আছে।২য় স্কন্ধ,অধ্যায়_৭,শ্লোক_৫১-৫২।
- পঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, বিষ্ণুপুরাণম্ , আর্য্যশাস্ত্র। পরাশর বলিলেন,যে কালের মধ্যে রৈবত ককুদ্মী ব্রহ্মলোকে অবস্থান করিয়া প্রত্যাবৃত্ত হন...।চতুর্থাংশ,অধ্যায়_২,শ্লোক_১-৬।
- শ্রীরামনারায়ণ বিদ্যারত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ। হে রাজন ! মনুর দশ সন্তানের মধ্যে...।নবম স্কন্ধ,অধ্যায়_৬,শ্লোক_৪-১২।
- পঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণ। নিমি নামক পরম ধর্মশীল এক রাজা ছিলেন; তিনি অদ্বিতীয় বীর্যবান এবং ইক্ষ্বাকু পুত্রগণের মধ্যে দ্বাদশ..।উত্তরকাণ্ড,সর্গ_৬৫,শ্লোক_৪-২২।
- পঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, বিষ্ণুপুরাণম্ , আর্য্যশাস্ত্র। পরাশর বলিলেন,ইক্ষ্বাকুর নিমি নামে যে পুত্র ছিলেন,তিনি কোনো সময়ে সহস্র সাংবৎসরব্যাপী যজ্ঞ আরম্ভ করিয়া...।চতুর্থ অংশ, অধ্যায়_৫, শ্লোক_১-১৪।
- পঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণ। রাজা রাম ! সেই শত পুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র অতিশয় মূঢ় ও মূর্খ হইয়াছিল..।উত্তরকাণ্ড,সর্গ_৯২,শ্লোক_১১-২০।
- পঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণ। নরব্যাঘ্র ! অনন্তর কিছুকালের পর ইক্ষ্বাকু নরপতির অলম্বুষা নামক ভার্যার গর্ভে..।আদিকাণ্ড,সর্গ_৪৭,শ্লোক_১০-১২।
- হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। তাহার পর মনু আপন পুত্র ক্ষুপকে প্রজাবর্গের অধিপতিরূপে অভিষিক্ত করিয়া তাহাদের রক্ষার জন্য ক্ষুপকে সেই তরবারি দান করিলেন..।শান্তি পর্ব,অধ্যায়_১৬১,শ্লোক_৭৩-৭৪।
- হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম। সঞ্জয় বলিলেন,মহারাজ ! জ্ঞানী নারদ ও বেদব্যাসের মুখে আপনি শুনিয়াছেন যে,অনেক রাজা সর্বগুণসম্পন্ন উচ্চ রাজবংশে জন্মিয়া...।আদিপর্ব,অধ্যায়_১,শ্লোক_১৮৪-১৯০।