ইউয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে তিব্বত
ইউয়ান প্রশাসনিক রাজত্বে তিব্বত তিব্বতের ইতিহাসে সেই সময়কালকে বোঝানো হয়, যে সময় তিব্বত প্রশাসনিক ও সামরিক ভাবে মঙ্গোল জাতির ইউয়ান রাজবংশ দ্বারা পরিচালিত হত, যদিও তিব্বতের প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী হলেও ইউয়ান রাজবংশ তিব্বতের প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল কিনা সেই নিয়ে বিদগ্ধজনের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে।[1][2][3][4] ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোল সেনাপতি দুর্দা তার্খানের নেতৃত্বে তিব্বত আক্রমণের পর ১২৪৪ খ্রিষ্টাব্দে সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের ষষ্ঠ সা-স্ক্যা-খ্রি-'দ্জিন কুন-দ্গা'-র্গ্যাল-ম্ত্শান-দ্পাল-ব্জাং-পো এই শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন।[5]:১১০
তিব্বত আভিযান
ইউয়ান রাজবংশ দ্বারা শাসনের পূর্বে মঙ্গোল সাম্রাজ্য তিব্বত আক্রমণ করে। ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট ওগেদেই খানের পুত্র খোদান খান প্রথম তিব্বত আক্রমণ করেন। পরবর্তীকালে ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে মোংকে খান দ্বিতীয়বার তিব্বত আক্রমণ করে সমগ্র তিব্বত মোঙ্গল শাসনাধীনে নিয়ে আসেন। কুবলাই খান সমগ্র অঞ্চলটিকে নিজের ইউয়ান রাজবংশের অধীনে নিয়ে আসেন।[6] সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের সপ্তম সা-স্ক্যা-খ্রি-'দ্জিন ও কুবলাই খানের আধ্যাত্মিক শিক্ষক 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পা তিব্বতের শাসক হিসেবে কুবলাই খানের নাম ঘোষণা করেন।
ক্ষমতা
মঙ্গোল সাম্রাজ্যের আধ্যাত্মিক প্রধান এবং তিব্বতের কার্যনির্বাহী প্রশাসক হিসেবে সা-স্ক্যা লামাদের অধীনে থেকে তিব্বত এই সময় যথেষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে। যদিও তিব্বতের প্রশাসনিক ও সামরিক শাসন শুধুমাত্র তিব্বতের জন্যই দায়িত্বপ্রাপ্ত জুয়ানঝেং ইউয়ান (চীনা: 宣政院) নামক এক উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাসম্পন্ন মঙ্গোল মন্ত্রিত্বের অধীনে ছিল। সা-স্ক্যা লামাদের ক্ষমতাকে সংযত করতে কুবলাই খান সা-স্ক্যা বৌদ্ধবিহারে একজন প্রশাসনিক আধিকারিককে নিযুক্ত করেন।[5]:১০৪ এরফলে তিব্বতে এক দ্ব্যর্থ শাসন প্রচলিত ছিল, যেখানে মূল ক্ষমতা ছিল প্রধানত মঙ্গোলদের হাতেই,[7] দুই পক্ষই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও[8] সম্রাটের ইচ্ছেই, এক্ষেত্রে ছিল অন্তিম ও সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত হওয়ায় মঙ্গোলরা সবসময়ই সা-স্ক্যা লামাদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাশালী ছিল।[7] কিন্তু মঙ্গোল সম্রাটদের ওপর প্রভাবের জন্য সা-স্ক্যা লামারা মঙ্গোলদের রাজসভায় যথেষ্ট প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার অধিকারী ছিল। 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পা ইউয়ান সাম্রাজ্যে বসবাসকারী সমস্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রধান হিসেবে বিবেচিত হতেন।[9]
কুবলাই খান এবং 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পা
'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পা ইউয়ান সম্রাট কুবলাই খানের আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা ও শিক্ষক ছিলেন। ১২৬০ খ্রিষ্টাব্দে কুবলাই খান মোঙ্গল সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে বসলে তিনি 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পাকে গুওশি (চীনা: 國師) বা জাতীয় ধর্মশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করলেন। তিব্বতের ইতিহাসে 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পা ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তিব্বতী ও মঙ্গোল বৌদ্ধ সমাজে রাষ্ট্র ও ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্কের এক রাজনৈতিক সূচনা করেন।[10]:১১৫[11] কুবলাই খানের সমর্থনে তিনি নিজেকে ও তার সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়কে তিব্বত ও মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ধর্মীয় নেতৃত্বে পরিণত করেন। ১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তিব্বত ফিরে গিয়ে শাক্য-ব্জাং-পো নামক সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের এক অণুগতকে প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত করে তিব্বতে সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের শাসন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেন। 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পা একজন সম্রাট ও ধর্মীয় নেতার মধ্যেকার সম্পর্কের ধরন নিয়ে মৌলিক রচনা করে মঙ্গোলদের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করতে সহায়তা করেন।[10] তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে মঙ্গোল রাজকুমারীদের বিবাহের মাধ্যমে সম্রাট ও 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পার মধ্যে সম্পর্ক আরো মজবুত হয়। ১২৭০ খ্রিষ্টাব্দে তাকে সমগ্র সাম্রাজ্যের ধর্মশিক্ষক বা দিশি (চীনা: 帝師) হিসেবে নিযুক্ত করা কুবলাই খানের নির্দেশে সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রধানেরা গুওশি এবং দিশি নামক পদাধিধাকারী হয়ে চীনে বসবাস করে সাম্রাজ্যের সমস্ত বৌদ্ধদের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারতেন।[12] তাদের প্রতিনিধি হিসেবে দ্পোন-ছেন ওয়াইলি: dpon chen) নামক একজন তিব্বতী আধিকারিক তিব্বতে প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন।[13]:১৪৪ এই ধরনের ব্যবস্থার ফলে সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রধানদের সঙ্গে দ্পোন-ছেন আধিকারকদের মাঝেমধ্যেই বিরোধের সৃষ্টি হত।[13]:২২১
নতুন লিপি সৃষ্টি
কুবলাই খান মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বহু ভাষা সমৃদ্ধ লিখন পদ্ধতিগুলিকে একত্র করে একটিমাত্র লিপি উদ্ভাবনের জন্য 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পাকে নির্দেশ দেন। ১২৬৮ খ্রিষ্টাব্দে 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পা তিব্বতী লিপি থেকে 'ফাগ্স-পা লিপি নামে এক নতুন ধরনের লিপির উদ্ভব করেন। কুবলাই এই লিপিকে সাম্রাজ্যের সরকারি লিপি বলে ঘোষণা করেন। এমনকি তিনি সাম্রাজ্যে বহুল প্রচলিত চীনা ও উইঘুর লিপির পরিবর্তে এই নতুন লিপি প্রচলনের ঘোষণা করলেও[10] 'ফাগ্স-পা লিপি সাম্রাজ্যে খুব একটা প্রচলিত হয়নি।[13]:১৫৮ ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউয়ান রাজবংশের পতনের সাথে সাথে এই লিপির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।[10]:১১৪-১১৭[11]
বিদ্রোহ
তিব্বতে সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের শাসন ব্কা'-ব্র্গ্যুদ ধর্মসম্প্রদায়ের 'ব্রি-কুং-ব্কা'-ব্র্গ্যুদ ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভিক্ষুরা মেনে নিতে পারেননি। চাগতাই খানাতের শাসনকর্তা দুওয়ার সহযোগিতায় ১২৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে কুবলাই খানের পৌত্র তেমুর বুকা মঙ্গোল সৈন্য নিয়ে 'ব্রি-কুং বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করে ও প্রায় ১০,০০০ মানুষকে হত্যা করে এই বিদ্রোহ দমন করেন।[5]
পতন
১৩৪৬ থেকে ১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে চীনে বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহের ফলে ইউয়ান রাজবংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এর সুযোগ নিয়ে সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়কে সরিয়ে দিয়ে ব্কা'-ব্র্গ্যুদ ধর্মসম্প্রদায়ের তা'ই-সি-তু-ব্যাং-ছুব-র্গ্যাল-ম্ত্শান ফাগ-মো-গ্রু-পা রাজবংশ স্থাপন করেন। ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র তিব্বত থেকে সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রভাব বিলুপ্ত হয়ে এই নতুন রাজবংশের অধীনে চলে আসে।[13]:১৯৪ কিন্তু ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউয়ান সাম্রাজ্যের পতন না হওয়া পর্যন্ত ফাগ-মো-গ্রু-পা রাজবংশ তাদের সঙ্গে বিরোধিতার পথে যাননি। ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ফাগ-মো-গ্রু-পা রাজবংশের পরবর্তী রাজা 'জাম-দ্ব্যাংস-শা-ক্যা-র্গ্যাল-ম্ত্শান মিং রাজবংশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন।
তথ্যসূত্র
- Kychanov, E.I. and Melnichenko, B.N. 2005. 'Istoriya Tibeta s Drevnikh Vremen do Nashikh Dnei [The History of Tibet from Ancient Times to the Present Days]. Moscow: Russian Acad. Sci. Publ.
- Smith, W.W. 1996. 'Tibetan Nation. A History of Tibetan Nationalism and Sino-Tibetan Relations'. Boulder: Westview.
- Sperling, E. 2004. 'The Tibet–China conflict: history and polemics'. - Policy Studies, v. 7 (Washington, East–West Center). - http://www.eastwestcenterwashington.org/publications/publications.htm ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ অক্টোবর ২০২০ তারিখে.
- 'The Mongols and Tibet. A Historical Assessment of Relations Between the Mongol Empire and Tibet'. 2009. DIIR Publ.
- Wylie, Turnell V. (1977) "The First Mongol Conquest of Tibet Reinterpreted," Harvard Journal of Asiatic Studies 37.1: 103-133.
- Schirokauer, Conrad. A Brief History of Chinese Civilization. Thomson Wadsworth, (c)2006, p 174
- Dawa Norbu. China's Tibet Policy, pp. 139. Psychology Press.
- Franke, H. 1981. Tibetans in Yuan China. - In: China Under Mongol Rule. Princeton.
- Dieter Schuh, Tibet unter der Mongolenherrschaft, in: Michael Weiers (editor), Die Mongolen. Beiträge zu ihrer Geschichte und Kultur, Darmstadt 1986, p. 283-289
- Laird, Thomas. The Story of Tibet: Conversations with the Dalai Lama (2006) Grove Press. আইএসবিএন ০-৮০২১-১৮২৭-৫
- F. W. Mote. Imperial China 900-1800. Harvard University Press, 1999. p.501.
- Uspensky, V.L. 1996. Lamaist Beijing: from Shun-Chi to the Tao-Kuang. –Oriens (Moscow), no. 4
- Rossabi, Morris. China Among Equals: The Middle Kingdom and Its Neighbors, 10th-14th Centuries (1983) Univ. of California Press. আইএসবিএন ০-৫২০-০৪৩৮৩-৯