আশাপূর্ণা দেবী
আশাপূর্ণা দেবী (৮ জানুয়ারি ১৯৪২ – ৮ জুলাই ১৯৬৬) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং শিশুসাহিত্যিক। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষত সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তার রচনার মূল উপজীব্য। ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ আশাপূর্ণা ছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষায় তার জ্ঞান ছিল না। বঞ্চিত হয়েছিলেন প্রথাগত শিক্ষালাভেও। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তি তাকে দান করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকার আসন। তার প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতা-বকুলকথা উপন্যাসত্রয়ী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। তার একাধিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। দেড় হাজার ছোটোগল্প ও আড়াইশো-র বেশি উপন্যাসের রচয়িতা আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার সহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য আকাদেমি ফেলোশিপ ভূষিত করেন।
আশাপূর্ণা দেবী | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | ৮ই জানুয়ারি ,1909 কলকাতা |
মৃত্যু | ১৩ই জুলাই,১৯৯৫ |
পেশা | লেখক, ঔপন্যাসিক |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
ধরন | উপন্যাস, ছোট গল্প |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি | প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা,বকুলকথা |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | জ্ঞানপীঠ পুরস্কার[1], রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমী ফেলোশিপ |
জীবনী
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
আশাপূর্ণা দেবীর জন্ম হয় ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি (বাংলা ২৪ পৌষ, ১৩১৫) শুক্রবার সকালে উত্তর কলকাতায় মাতুলালয়ে। পিতার নাম হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং মাতা সরলাসুন্দরী দেবী । হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ; সেযুগের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকাগুলিতে ছবিও আঁকতেন। তার রাজভক্তি ও রক্ষণশীলতার বিপরীতে অবস্থান করতেন মা সরলাসুন্দরী দেবী। সাহিত্যপাঠই ছিল তার জীবনের একমাত্র ‘পরমার্থ’। রাজনৈতিক আদর্শে ছিলেন কট্টর ব্রিটিশ-বিদ্বেষী স্বদেশী।[2]
গুপ্ত-পরিবারের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার বেগমপুরে। যদিও আশাপূর্ণা দেবীর জীবনের সঙ্গে এই অঞ্চলটির কোনও প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তার ছোটোবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতাতেই, ঠাকুরমা নিস্তারিনী দেবীর পাঁচ পুত্রের একান্নবর্তী সংসারে। পরে হরেন্দ্রনাথ যখন তার আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নিজস্ব বাসভবনে উঠে আসেন আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর। কিন্তু বাল্যের ওই কয়েকটি বছর তার মনে গভীর ছাপ রেখে যায়। পরবর্তীকালে সাহিত্যেও নানা ভাবে এঁকেছিলেন ‘দেহে ও মনে অসম্ভব শক্তিমতী’ তার সেই ঠাকুরমার ছবি।[3]
শৈশব ও শিক্ষা
প্রথাগত শিক্ষার সৌভাগ্য আশাপূর্ণার হয়নি ঠাকুরমার কঠোর অনুশাসনে। পরবর্তীজীবনে এক স্মৃতিচারণায় এই প্রসঙ্গে আশাপূর্ণা বলেছিলেন, “...ইস্কুলে পড়লেই যে মেয়েরা... বাচাল হয়ে উঠবে, এ তথ্য আর কেউ না জানুক আমাদের ঠাকুমা ভালোভাবেই জানতেন, এবং তাঁর মাতৃভক্ত পুত্রদের পক্ষে ওই জানার বিরুদ্ধে কিছু করার শক্তি ছিল না।”[4] তবে এই প্রতিকূল পরিবেশেও মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে দাদাদের পড়া শুনে শুনে শিখে গিয়েছিলেন পড়তে। বর্ণপরিচয় আয়ত্ত করেছিলেন বিপরীত দিক থেকে।[5] মা সরলাসুন্দরী ছিলেন একনিষ্ঠ সাহিত্য-পাঠিকা। সেই সাহিত্যপ্রীতি তিনি তার কন্যাদের মধ্যেও সঞ্চারিত করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সবুজপত্র, বঙ্গদর্শন, বসুমতী, সাহিত্য, বালক, শিশুসাথী, সন্দেশ প্রভৃতি ১৬-১৭টি পত্রিকা এবং দৈনিক পত্রিকা হিতবাদী তো বাড়িতে আসতই, তাছাড়াও সরলাসুন্দরী ছিলেন স্বনামধন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, জ্ঞানপ্রকাশ লাইব্রেরি ও চৈতন্য লাইব্রেরির সদস্য। বাড়িতে সেযুগের সকল প্রসিদ্ধ গ্রন্থের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডারও ছিল। এই অণুকূল পরিবেশে মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই পাঠ্য ও অপাঠ্য নির্বিশেষে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করে দেন আশাপূর্ণা। পরবর্তী কালে এই বাল্যকাল সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “হিসেব মতো আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে, সংসার ঊর্ধ্বের একটি স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ।”[6]
ছেলেবেলার দিনগুলি সম্পর্কে আশাপূর্ণা বলেছেন, “...খুব ডাকাবুকো ছিলাম। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ওড়াতাম, মারবেল খেলতাম। ক্যারাম খেলতাম দাদাদের সঙ্গে।”[6] আবার পিতামাতার সবচেয়ে বাধ্য মেয়ে হওয়ার জন্য তাদের সবচেয়ে প্রিয়পাত্রীও হয়ে উঠেছিলেন। সেদিনের নির্মীয়মান কলকাতা মহানগরী ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। আর প্রিয় ছিলেন দিদি রত্নমালা ও বোন সম্পূর্ণা। তারা তিনজনে ছিলেন, আশাপূর্ণার ভাষায়, “...একটি অখণ্ড ট্রিলজির অংশ। এক মলাটে তিনখানি গ্রন্থ।” আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নতুন বাড়িতে উঠে আসার কিছুদিনের মধ্যে এই অখণ্ড আনন্দে বিচ্ছেদের সুর বাজে। বিয়ে হয়ে যায় দিদি রত্নমালার। সেই নিঃসঙ্গতা দূর করতে একদিন আশাপূর্ণা ও সম্পূর্ণা করে ফেলেন এক দুঃসাহসিক কাজ। দুই বোনের সাক্ষরে চিঠি পাঠান রবীন্দ্রনাথকে। আবদার, “নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে একটি উত্তর দেবেন।” [7] কাঙ্ক্ষিত সেই উত্তর আসতেও দেরি হয়নি। আর এর পরেই বহির্বিশ্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘স্যাঁতস্যাঁতে বাংলাদেশের বিদ্রোহিনী নারী’র[8]।
১৯২৪ সালে, মাত্র ১৫ বছর ৮ মাস বয়সে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কালিদাস গুপ্তের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
আশাপূর্ণা দেবী রচিত গ্রন্থাবলি
|
|
|
|
|
তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছোটগল্প- পাতাচাঁপা, সর্ষে ও ভূত, ডেইলি প্যাসেজ্ঞার, কামধেনু, শুনে পুন্যবান, অভিনেত্রী, ক্যাকটাস্ প্রভৃতি।
পুরস্কার ও সম্মাননা
অসামান্য সাহিত্যকীর্তির জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন লেখিকা। যেমন -
- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লীলা পুরস্কার (১৯৫৪)
- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী দাসী স্বর্ণপদক (১৯৬৬)
- পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (১৯৬৬)
- ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমির জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৭৬)
- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের হরনাথ ঘোষ পদক (১৯৮৮)
- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯৬৩)
- ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী (১৯৭৬)
- জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি.লিট (১৯৮৩)
- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি.লিট (১৯৮৭)
- বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি.লিট (১৯৮৮)
- যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি.লিট (১৯৯০)
- বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশিকোত্তম (১৯৮৯)
পাদটীকা
- "জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রাপ্ত জনেদের নামের আধিকারিক তালিকা"। জ্ঞানপীঠ ওয়েবসাইট। ১৩ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
- জীবনী গ্রন্থমালা ৪৬ : আশাপূর্ণা দেবী, উপাসনা ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৪, পৃষ্ঠা ১০-১১
- আভা, শারদীয়া সংখ্যা, ১৩৯০, পৃষ্ঠা ১৭১ দ্রঃ জীবনী গ্রন্থমালা ৪৬ : আশাপূর্ণা দেবী, উপাসনা ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৪, পৃষ্ঠা ১০
- আর এক আশাপূর্ণা, পৃষ্ঠা ৪ দ্রঃ নূপুর গুপ্ত লিখিত আশাপূর্ণা দেবী – একটি স্মরণীয় জীবন : আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী, সুশান্তকুমার গুপ্ত সম্পাদিত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃষ্ঠা ii
- জীবনী গ্রন্থমালা ৪৬ : আশাপূর্ণা দেবী, উপাসনা ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৪, পৃষ্ঠা ১২
- আর এক আশাপূর্ণা, আশাপূর্ণা দেবী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৭ (১৪০৪), পৃষ্ঠা ৩৪
- আর এক আশাপূর্ণা, আশাপূর্ণা দেবী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৭ (১৪০৪), পৃষ্ঠা ৩৭
- কথাসাহিত্য, কার্তিক ১৩৮১, (আশির্বাদ : বনফুল), পৃষ্ঠা ১০ ; দ্রষ্টব্য কথাসাহিত্যিক বনফুল আশাপূর্ণা দেবীকে ‘স্যাঁতস্যাঁতে বাংলাদেশের বিদ্রোহিনী নারী’ বলেছিলেন।
- "শ্রীমতী আশাপূর্ণা দেবী" (পিডিএফ)। অজানা প্যারামিটার
|1=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)