আবু তাহের
আবু তাহের, বীর উত্তম (১৪ নভেম্বর ১৯৩৮ - ২১ জুলাই ১৯৭৬) একজন বাংলাদেশি সেনা অফিসার, মুক্তিযোদ্ধা এবং বামপন্থী বিপ্লবী নেতা ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য রাখার জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মূল পরিকল্পনাকারী ও পরিচালনাকারী।
আবু তাহের | |
---|---|
![]() | |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | ১৪ নভেম্বর ১৯৩৮![]() |
মৃত্যু | ২১ জুলাই ১৯৭৬ ঢাকা, বাংলাদেশ |
মৃত্যুর কারণ | মৃত্যুদন্ড |
নাগরিকত্ব | ![]() (১৯৩৮–১৯৪৭) ![]() (১৯৪৭–১৯৭১) ![]() (১৯৭১–১৯৭৫) |
জাতীয়তা | বাংলাদেশি |
রাজনৈতিক দল | জাসদ |
সম্পর্ক | লুৎফা তাহের (স্ত্রী)
মহিউদ্দিন আহমেদ (পিতা) আশরাফুন্নেসা (মাতা) |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | এমসি কলেজ |
পুরস্কার | বীর উত্তম মেরুন প্যারাস্যুট উইং |
সামরিক পরিষেবা | |
আনুগত্য | ![]() ![]() |
কাজের মেয়াদ | ![]() ![]() |
পদ | লেফটেনেন্ট কর্নেল |
কমান্ড | মুক্তিবাহিনীর ১১নং সেক্টর (১৯৭১) গণবাহিনী (১৯৭২-১৯৭৫) |
যুদ্ধ | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ বাংলাদেশে অভ্যুত্থান |
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
আবু তাহের ব্রিটিশ শাসিত ভারতেবর্ষের আসাম প্রদেশের বদরপুরে ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পরে আসাম থেকে তার পরিবার বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলায় ফিরে আসে। তার বাবার নাম মহিউদ্দিন আহমেদ এবং মায়ের নাম আশরাফুন্নেসা। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ পেশায় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ও পরবর্তীতে পাকিস্তান রেলওয়ের একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। তার মা ছিলেন একজন গৃহিণী। আবু তাহের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করেন চট্টগ্রামের প্রবর্তক বিদ্যালয় ও কুমিল্লার ইউসুফ বিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের আগপর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অল্প কিছুদিন পড়াশোনা করেন।[1]
কর্মজীবন
১৯৬১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কাশ্মীর আর শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধ করেন তিনি৷ সে যুদ্ধে তিনি আহতও হন৷ তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একমাত্র বাঙালি অফিসার হিসাবে তাকে 'মেরুন প্যারাস্যুট উইং' নামক সম্মাননা প্রদান করা হয়৷
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার হিসাবে তাহের কমান্ডো প্রশিক্ষণ লাভ করেন ও পরে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৬৯ সালে আবু তাহের যুক্তরাষ্ট থেকে স্পেশাল কমান্ডো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়ে ছিলেন। সেখান থেকে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে রাতের অন্ধকারে ভারতে পালিয়ে যান। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সময় তার সহযোগী ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন, মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, মঞ্জুরের স্ত্রী সন্তানসহ কয়েকজন। তারপর বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী এর নির্দেশে সেক্টরগুলো ঘুরে দেখেন এবং কৌশলগতভাবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ১১ সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন। যুদ্ধের সময় তার স্টাফ অফিসার ছিলেন নিজের আপন ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন। তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ বীর বিক্রম, ছোট ভাই আবু সাঈদ আহমেদ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক, শাখাওয়াত হোসেন বাহার বীর প্রতীক এবং ছোট বোন ডলি আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের সময় তাহের সম্মুখ সমরে আহত হয়ে এক পা হারান। কর্নেল তাহেরের সব ভাইবোন মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বে ১১ নং সেক্টরে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছেন।[2] ভাই-বোনদের এই দলটিকে "ব্রাদার্স প্লাটুন" বলে ডাকা হত।
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের পরে তাহের প্রথমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু মতবিরোধ এবং ব্যক্তিগত আক্ষেপের কারণে ১৯৭২ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদের শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। তিনি বলশেভিকদের বিপ্লবী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।[3][4] ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর তার নেতৃত্বে সিপাহী-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তার পতন ঘটিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত করা হয়। তবে জিয়াউর রহমান প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে সিপাহীরা বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে। শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ দমন করেন।
পরবর্তীতে জিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ফলে তাহেরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাঁকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।[5] ২০১১ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির রায়কে অবৈধ ঘোষণা করে।[6]
ব্যক্তিগত জীবন
আবু তাহের ১৯৬৯ সালের ৭ই আগস্ট লুৎফাকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় লুৎফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী ছিলেন। লুৎফার গর্ভে তাহেরের তিন সন্তান জন্ম নেয়।।
তথ্যসূত্র
- "তাহের, কর্নেল আবু - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- "দৈনিক প্রথম আলো"। ২০১৬-১১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-০৩।
- হোসেন, মোহাম্মদ আনোয়ার (২২ জুলাই ২০২০)। "অক্টোবর বিপ্লব ও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান"। bdnews24। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০২২।
- হোসেন, মোহাম্মদ আনোয়ার (৭ নভেম্বর ২০১৭)। "অক্টোবর বিপ্লব ও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান"। bdnews24। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০২২।
- একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (দ্বিতীয় খন্ড)। প্রথমা প্রকাশন। মার্চ ২০১৩। পৃষ্ঠা ৩৮। আইএসবিএন 9789849025375।
- "আজ আমি আনন্দিত, আমি গর্বিত : লুৎফা তাহের"। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম অনলাইন। ২২ মার্চ ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২৫ জানুয়ারি ২০১৮।