আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ
আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ (৫৮৫ খ্রিঃ- ৬২৫ খ্রিঃ) মুহাম্মদের একজন সাহাবা বা সঙ্গি ছিলেন । তিনি একদিকে মুহাম্মাদের ফুফাত ভাই এবং অন্যদিকে মুহাম্মদের শ্যালক ছিলেন ।[1]
নাম ও বংশ পরিচয়
তিনি মুহাম্মদ এর নবুয়তের ৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন । আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের মূলনাম আবদুল্লাহ এবং উপনাম আবু মুহাম্মাদ ।তার পিতার নাম জাহাশ এবং মাতার নাম উমায়মা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব ।যিনি মুহাম্মদ এর ফুফু ছিলেন । এবং তার বোন যয়নাব বিনতু জাহাশ মুহাম্মদের স্ত্রী ছিলেন । তাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ মুহাম্মদ এর ফুফাতো ভাই ও শ্যালক ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ ও হিজরত
ইসলাম পূর্ব যুগে তিনি বনু আবদি শামস গোত্রের হারব ইবনে উমাইয়ার সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ প্রথম ভাগে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবাদের মধ্যে অন্যতম। মুহাম্মদ দারুল আরকাম থেকে ইসলাম প্রচারের আগেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন ।
হাবশায় হিজরত
ইসলাম গ্রহণের পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ কুরাইশদের অত্যাচারের রোষানলে পরেন। এই কারণে তিনি দুইবার হাবশায় হিজরত করেন। শেষের হিজরতে তার পরিবারের সকল সদস্য অর্থাৎ দুই ভাই আবু আহমদ ইবনে জাহাশ ও উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ । এবং তিন বোন যয়নাব বিনতে জাহাশ , উম্মে হাবীবা, হামনা বিনতে জাহাশ সঙ্গে ছিলেন । এবং উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশের স্ত্রী উম্মে হাবিবা বিনতে আবি সুফিয়ানও সঙ্গে ছিলেন । উল্লেখ্য তার ভাই উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ হাবশায় গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে এবং উবায়দুল্লাহ ইসলাম ত্যাগ করায় তার স্ত্রী রামালাহ বিনতে আবু সুফিয়ান (উম্মে হাবীবা) তার থেকে পৃথক হয়ে যান এবং পরবর্তীকালে মুহাম্মদ তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন।[2]
মদিনায় হিজরত
হাবশায় কিছুকাল অবস্থানের পর হযরত আবদুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কায় ফিরে এসে দেখেন তার গোত্র বনু গানামের সকল সদস্য ইসলাম গ্রহণ করেছেন তখন মুহাম্মদ এর অনুমতি নিয়ে গোত্রের সকলকে সঙ্গে করে মদিনায় হিজরাত করেন। উল্লেখ্য এরপরে বনু গানামের একটি লোককেও মক্কায় পাওয়া যায়নি । এরপরে আবু জাহেলের নেতৃত্বে কুরাইশরা বনু গানামের সকল ঘরের সবকিছু লুটপাট করে ।
মদিনা পৌঁছার পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের গোটা গোত্রকে হযরত আসিম ইবনে সাবিত আল-আনসারী আশ্রয় প্রদান করেন। পরে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও আসিম ইবনে সাবিতএর মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।
যুদ্ধে অংশগ্রহণ
নাখলা অভিযানের ঘটনা
দ্বিতীয় হিজরির রজব মাসে মুহাম্মদ আটজন সাহাবীর একটি দলকে নির্বাচন করলেন একটি অভিযানের জন্য,এই দলের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাসও ছিলেন। এরপর আবদুল্লাহকে দলের নেতা বানিয়ে কুরাইশদের গতিবিধি জানতে মক্কা ও তায়েফের মাঝখানে নাখলা নামক স্থানে পাঠালেন । তারা কুরাইশদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলো । একদিন চারজন ব্যক্তির ( আমর ইবনুল হাদরামি, হাকাম ইবনে কায়সান, উসমান ইবনে আবদিল্লাহ এবং মুগীরা ইবনে আবদিল্লাহ ) একটি কুরাইশ বাণিজ্য কাফিলা এই পথ দিয়ে অতিক্রম করছিল ।তখন আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ তার সঙ্গীদের সাথে এই কাফেলা আক্রমণ করার ব্যপারে পরামর্শ করলো এবং সবার সম্মতিতে এই কাফেলা আক্রমণ করে কাফিলার নেতা আমর ইবনুল হাদরামিকে হত্যা, উসমান ইবনে আবদিল্লাহ ও হাকাম ইবনে কায়সানকে বন্দী করেন এবং মুগীরা ইবনে আবদিল্লাহ পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য এই মাস ছিলো রজব মাস এবং তখন আরব সমাজে রজব মাস সহ মুহররম,জ্বিলকদ ও জ্বিলহজ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিলো । অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ এই কাফেলা থেকে প্রাপ্ত গণিমতের এক পঞ্চমাংশ মুহাম্মদ কে এবং বাকিগুলো নিজেদের দলের মধ্যে ভাগ করে দিতে উদ্যত হলে মুহাম্মদ তার প্রতি ভৎসর্না করলেন ।
এই নিষিদ্ধ মাসে তারা কুরাইশদের হত্যা ও আক্রমণ করার কারণে মুহাম্মদ ও তার অনন্য সাহাবারা তাদের বিদ্রুপ করলেন এবং মুহাম্মদ ঐ যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত গণিমত ও অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন । পরে আল্লাহ্ এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সাহাবাদের পক্ষে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করলে মুহাম্মদ গণিমতের অর্থ গ্রহণ করতে রাজি হন ও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন ।
আল্লাহ্ বলেন,
“ | ‘হারাম (নিষিদ্ধ) মাস সম্পর্কে তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে, সে মাসে যুদ্ধ করা কি জায়েয? আপনি বলে দিন, এই মাসে যুদ্ধ করা বড় ধরনের অপরাধ। আর আল্লাহর রাস্তায় বাধা দেওয়া, তাঁকে অস্বীকার করা, মসজিদে হারাম (কা’বা) থেকে বিরত রাখা এবং তার অধিবাসীদের সেখান থেকে বিতাড়িত করা আল্লাহর কাছে তার থেকেও বড় অপরাধ। আর ফিতনা বা বিপর্যয় সৃষ্টি করা হত্যা অপেক্ষাও খারাপ কাজ।’ [আল বাকারাহ- ২১৭] | ” |
এভাবে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ মুসলমানদের কোন দলের সর্বপ্রথম দলপতি হলেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি গনীমাতের ব্যাপারে সর্বপ্রথম এক পঞ্চমাংশ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং আল্লাহ এই ব্যবস্থার সমর্থন করে কুরআনে আয়াত নাযিল করেন।[3]
উহুদ যুদ্ধে
আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস বর্ণনা করেছেন, উহুদ যুদ্ধের পূর্বে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ তার নিজের শাহাদতের জন্য দোয়া করেছিলেন,আবদুল্লাহ বলেছিলেন,
হে আল্লাহ, "আমাকে এমন প্রতিদ্বন্দ্বী দান কর, যে হবে ভীষণ সাহসী ও দ্রুত উত্তেজিত। আমি তোমার রাস্তায় তার সাথে যুদ্ধ করবো। সে আমাকে হত্যা করে আমার নাক কান কেটে ফেলবে। যখন আমি তোমার সাথে মিলিত হব এবং তুমি জিজ্ঞেস করবে, ‘আবদুল্লাহ, তোমার নাক-কান কীভাবে কাটা গেল?’ তখন আমি বলবো, তোমার ও তোমার রাসূলের জন্য।"[4]
তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে উহুদ প্রান্তরে তুমুল যুদ্ধ। এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের তরবারিটি ভেঙ্গে যায়। তখন মুহাম্মাদ তাকে খেজুর গাছের একটি ডাল ভেঙ্গে দেন । আবদুল্লাহ এই ডাল দিয়েই দীর্ঘসময় যুদ্ধ করতে থাকেন। এবং এক পর্যায়ে আবুল হাকাম ইবনে আখনাস সাকাফীর তরবারির একটি প্রচন্ড আঘাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। মুশরিকরা তার দেহের বিকৃতি সাধন করে এমনকি নাক,কান কেটে সুতায় মালা গাঁথে ।
চরিত্র
আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ইসলাম ও মুহাম্মাদের জন্য নিবেদিত একটি প্রান ছিলো ।ইসলামের যেকোন আহবান তাকে দুনিয়ার সব কিছু থেকে উদাসীন করে তোলে ।[5] এসব গুণাবলীর কারণে তিনি ‘আল-মুজাদ্দা’ ফিল্লাহ’ (আল্লাহর রাস্তায় কানকাটা) এ উপাধি তিনি লাভ করেন। তিনি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সাহাবা ছিলেন । বদর যুদ্ধে বন্দীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ আবু বকর, উমার ও আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের সাথে পরামর্শ করেছিলেন।[5]
মৃত্যু
আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে উহুদের যুদ্ধে আবুল হাকাম ইবনে আখনাস সাকাফীর তরবারির আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিলো ৪০ বছর। তার মামা হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব সাথে একই কবরে তাকে দাফন করা হয়।
তথ্যসূত্র
- (বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – দ্বিতীয় খন্ড)।
- [আল ইসাবা ২/২৭২]।
- [আল-ইসতিয়াব গ্রস্থ ]।
- উসদ আল-গাবাহ ফি মারিফাত আল-সাহাবাহ। মূল: আলী ইবনে আসির। উর্দু অনুবাদক: আব্দুর শাকুর ফারুকী। আইএসবিএন ৯৭৮৩১৫৯২৪৪৭৮৫
- [আল-ইসাবা-২/২৮৭]।