আপিয়া
আপিয়া (Apia) দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র সামোয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। শহরটি সামোয়া দ্বীপপুঞ্জের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ উপোলু-র উত্তর উপকূলের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। আপিয়া সামোয়ার একমাত্র বড় শহর, প্রধান বন্দর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। এটি প্রশাসনিকভাবে তুয়ামাসাগা জেলার (স্থানীয় ভাষায় "ইতুমালো") মধ্যে পড়েছে।
আপিয়া | |
---|---|
আপিয়ার মানচিত্র | |
আপিয়া | |
স্থানাঙ্ক: ১৩°৫০′ দক্ষিণ ১৭১°৪৫′ পশ্চিম | |
দেশ/রাষ্ট্র | সামোয়া |
জেলা | তুয়ামাসাগা |
নির্বাচনী এলাকা | পশ্চিম ভাইমাউগা এবং পূর্ব ফালেয়াতা |
প্রতিষ্ঠা | ১৮৫০-এর দশক |
রাজধানীর মর্যাদালাভ | ১৯৫৯ |
আয়তন | |
• শহর | ৪৭.৮০ বর্গমাইল (১২৩.৮১ বর্গকিমি) |
• পৌর এলাকা | ২০.০ বর্গমাইল (৫১.৮ বর্গকিমি) |
উচ্চতা[1] | ৭ ফুট (২ মিটার) |
জনসংখ্যা (২০১১) | |
• শহর | ৩৬,৭৩৫ |
• জনঘনত্ব | ৭৭০/বর্গমাইল (৩০০/বর্গকিমি) |
• পৌর এলাকা | ৩৬,৭৩৫ |
• পৌর এলাকার জনঘনত্ব | ১,৮০০/বর্গমাইল (৭১০/বর্গকিমি) |
সময় অঞ্চল | ইউটিসি+১৩:০০ (ইউটিসি+১৩) |
• গ্রীষ্মকালীন (দিসস) | ইউটিসি+১৪:০০ (ইউটিসি+১৪) |
জলবায়ু | Af |
আপিয়ার জলবায়ু ক্রান্তীয় অতিবৃষ্টি অরণ্য প্রকৃতির। এখানকার গড় তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা কম। আপিয়াতে প্রায় ৩৭ হাজার লোকের বাস। শহরের আয়তন প্রায় ৬০ বর্গকিলোমিটার। শহরের কাছে ফালেওলোতে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবস্থিত। এছাড়া শহরটি নৌপথে মার্কিন সামোয়া দ্বীপের পাগো পাগো শহরের সাথে সংযুক্ত।
এখানে থেকে কোপরা (শুকানো নারিকেলের শাঁস), কলা, কাকাও ও কফি রপ্তানি করা হয়। পর্যটন খাতে কর্মসংস্থান হলেও বেশির ভাগ স্থানীয় অধিবাসী অর্থকরী ফসল বা খাদ্যশস্য উৎপাদন করে ও বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে। শহরের কাছে মোটরযানের যন্ত্রাংশ নির্মাণের একটি কারখানা আছে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ সমবায়ের কারখানাও আছে। তারো ও অন্যান্য মূল-জাতীয় খাদ্যশস্য মার্কিন সামোয়াতে জাহাজযোগে প্রেরণ করা হয়।
১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সামোয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখানকার একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞান বিদ্যালয়টি ১৯৭৭ সাল থেকে এখানে অবস্থিত। আপিয়াতে একটি মানমন্দির, আইনপ্রণয়ন সভা আছে। মুলিনু উপদ্বীপটি আপিয়া পোতাশ্রয়কে ভাইউসু উপসাগর থেকে পৃথক করেছে এবং এখানে একটি সম্প্রচার কেন্দ্র অবস্থিত। আপিয়াতে অনেক ঐতিহাসিক স্থান আছে। পর্যটকদের জন্য তাই এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান। শহরে বিখ্যাত ১৯শ শতকীয় স্কটিশ লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের বাসভবন অবস্থিত, যেটিকে বর্তমানে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ভাইলিমা নামের এই বাসভবনটিতে বর্তমানে সামোয়ার রাষ্ট্রপ্রধানও বাস করেন। লেখক তার জীবনের শেষ কয়েকটি বছর এখানে কাটান। শহরের ঠিক দক্ষিণে নিকটবর্তী ভায়েয়া পর্বতের ৪৬০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট শীর্ষে লেখকের সমাধি অবস্থিত। শহরকেন্দ্রে সামোয়া জাদুঘরে দেশটির প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি তুলে ধরা হয়েছে। একটি ঔপনিবেশিক আমলের ভবনকে ১৯৯৯ সালে রূপান্তরিত করে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মাকেতি ফু নামের বাজারটি ২৪ ঘণ্টা গমগম করে এবং এখানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত টাটকা খাবার পাওয়া যায়। "কুমারী মেরির নিষ্কলঙ্ক গর্ভাধান" নামের ক্যাথেড্রাল বা গির্জাতে কাঠের তৈরি কারুকার্যময় ছাদটি দর্শনীয়। সামোয়ার সাংস্কৃতিক গ্রাম এলাকাটিতে পর্যটকদের জন্য সংক্ষিপ্ত সফরের ব্যবস্থা আছে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী দারুকলা প্রদর্শন করা হয়। পূর্ব উপকূলে পিউলা গুহার পুষ্করিণীটি সাঁতারের জন্য উন্মুক্ত; এটি দুইটি গুহা ও একটি ভূগর্ভস্থ নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত। পেয়াপেয়া নামের লাভা দিয়ে তৈরী গুহাতে বহু আবাবিল পাখির বাসা আছে। আপিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে পাপাসে-এয়া পিচ্ছিল শিলাগুলিতে পিচ্ছিল পানিপথে নিচে নামার ব্যবস্থা আছে, যেগুলি প্রাকৃতিকভাবে জলাশয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। দক্ষিণে পাপাপাপাইতাই জলপ্রপাত নাটকীয়ভাবে একটি খাদে গিয়ে পড়েছে। আপিয়ার ভাইয়ালা সমুদ্র সৈকতের কাছে সাগরে পালোলো ডিপ মেরিন রিজার্ভটি মূলত ক্রান্তীয় মাছসমৃদ্ধ একটি প্রবাল প্রাচীর; এখানে সাঁতার ও স্নর্কেলিংয়ের (বাতাস নেবার নল সহকারে ডুবসাঁতার) ব্যবস্থা আছে।
আপিয়াতে সম্ভবত প্রথম খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে পলিনেশীয়রা প্রথম বসতি স্থাপন করে। এটি মূলত একটি ছোট গ্রাম ছিল। ১৮৩০-এর দশকে ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারক ও বণিকেরা এখানে আগমন করে। এরপর এটি দ্রুত একটি ইউরোপীয় ধাঁচের বন্দরে পরিণত হয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলির মধ্যকার বাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করে। ১৯শ শতকের শেষভাগে এসে তিনটি বৃহৎ শক্তি-- জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামোয়া দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ১৮৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য একটি জার্মানি-বিরোধী মৈত্রী স্থাপন করে। সেসময় আপিয়া জার্মানির অধীন "পশ্চিম সামোয়া"-র অংশ ছিল এবং ব্রিটিশ ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলির এখানে বোমাবর্ষণ করে। সে বছরেই স্বাক্ষরকৃত একটি চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি পশ্চিম সামোয়াকে নিজের অধীনস্থ অঞ্চলে পরিণত করে নেয় এবং আপিয়াকে এই অঞ্চলের রাজধানীর মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯০০ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এটি "জার্মান সামোয়া" নামক অঞ্চলের রাজধানী ছিল। ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) নিউজিল্যান্ড পশ্চিম সামোয়াকে দখল করে নেয়। যুদ্ধের পরে নিউজিল্যান্ড আপিয়াকে কেন্দ্র করে অঞ্চলটির প্রশাসনের দায়িত্ব নেয়। এ ব্যাপারে প্রথমে নিউজিল্যান্ড ১৯২৮ সালে লিফ অফ নেশনসের মনোনয়ন লাভ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে পশ্চিম সামোয়া জাতিসংঘ ট্রাস্ট অঞ্চলের দায়িত্ব নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি স্থাপন করে এবং তারা অনেকগুলি সড়ক ও একটি বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ পথ নির্মাণ করে। ১৯৬২ সালে সামোয়া পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে আপিয়া নতুন রাষ্ট্রের রাজধানীতে পরিণত হয়।
১৮৮৯ সালে মার্চ মাসে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বা তাইফুন দ্বীপটিতে আঘাত হানলে তিনটি জার্মান ও তিনটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়, কেবল ব্রিটিশ জাহাজটি রক্ষা পায়। ২০০৯ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর একটি সমুদ্রতলস্থ ভূমিকম্প (রিখটার মাপনীতে যার মাত্রা ছিল ৮.৩) সামোয়া দ্বীপগুলিকে কাঁপিয়ে তোলে। ভূমিকম্পটি দ্বীপ থেকে প্রায় ১৯০ কিলোমিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত হলেও এতে যে সুনামির সৃষ্টি হয়, তাতে বেশ কয়েকটি সুউচ্চ জলোচ্ছ্বাসে সামোয়া দ্বীপগুলি প্লাবিত হয়, অনেক গ্রাম মাটিতে মিশে যায় এবং বেশ কয়েক ডজন লোক মারা যায়।