আজারবাইজানের ইতিহাস

আজারবাইজান (আজারবাইজানি: Azərbaycan) ইউরেশিয়ার ককাসাস অঞ্চলের একটি দেশ। আজারবাইজানের ইতিহাসে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার অবদান আছে। এগুলি হল ১১শ শতকের সেলজুক তুর্কি জাতি এবং প্রাচীন পারসিক জাতির সভ্যতা। আজারবাইজান নামটি সম্ভবত ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ "অগ্নিভূমি"। শব্দটি দিয়ে আজারবাইজানের খনিজ তেল সম্পদ (প্রাচীনকাল থেকেই এগুলি সম্বন্ধে জানা ছিল) এবং জরথুষ্ট্রবাদের একটি কেন্দ্র হিসেবে এর ভূমিকা-দুইই নির্দেশ করা হয়। ইরানীয় দুই প্রদেশ পূর্ব আজারবাইজান ও পশ্চিম আজারবাইজান স্বাধীন আজারবাইজান রাষ্ট্রের সীমান্তে অবস্থিত। তবে আধুনিক যুগে এসে এই তিনটি একত্রে মিলে একটিমাত্র রাষ্ট্র গঠন করেনি।

৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে আরবদের আজারবাইজান বিজয় ও এখানকার লোকদের ইসলাম ধর্মে রূপান্তরের[1] ঘটনার আগে আজারবাইজানের ইতিহাস কী ছিল, তা সম্বন্ধে সঠিক জানা যায় না। আরব সাম্রাজ্যের পতনের পরে মঙ্গোল জাতি আজারবাইজানে ধ্বংসলীলা চালায়। তবে ১৩শ-১৫শ শতকে মঙ্গোল ইল-খান, স্থানীয় শিরভান শাহ এবং পারস্যের সাফাভিদ রাজবংশের অধীনে এলাকাটি পুনরায় সমৃদ্ধি লাভ করে।

ইউরোপমধ্য এশিয়ার মধ্যকার স্থলবাণিজ্যপথের উপর এবং কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত বলে বহু শতাব্দী ধরে রাশিয়া, পারস্য এবং উসমানীয় শাসকেরা আজারবাইজান দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। অবশেষে ১৮২৮ সালে তুর্কমেনচায় চুক্তির মাধ্যমে রুশরা আজারবাইজান অঞ্চলটি পারস্যের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। একই সাথে স্থানীয় আজারবাইজানি খানদের রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে। ঐ সময়ে নির্ধারিত সীমান্তই আজারবাইজান ও ইরানের বর্তমান সীমান্ত নির্ধারণ করেছে। ১৮৭০-এর দশক থেকে আজারবাইজানের তেলক্ষেত্রগুলির আধুনিক নিষ্কাশন শুরু হয় এবং এর ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে একাকাটি অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ

আজারবাইজানের প্রাগৈতিহাসিকযুগকে প্রস্তর, ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগে ভাগ করা যায়। প্রস্তর যুগের তিনটি ভাগ -প্যালেওলিথিক, মেসোলিথিক এবং নিওলিথিক।


পুরা প্রস্তর যুগ বা আদিম প্রস্তর যুগ বা প্যালেওলিথিক

প্যালেওলিথিক যুগকে আবার তিনভাগে বিভক্ত করা যায় - নিম্ন, মধ্যম এবং উচ্চ। এটি শুরু হয়েছিল এই অঞ্চলে প্রথম মানুষের পদার্পণের থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১২ সহস্রাব্দ পর্যন্ত।


ইউরেশিয়ার আদিম মানুষদের একটি বসবাস ছিল ফুজুলি অঞ্চলের আজিখ গুহা। এই গুহার নিচেই ৭ লক্ষ বছরের পুরনো প্রাক-আশুলিয়ান সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে মাম্মাদালি হুসেইনভ প্রায় ৩ লক্ষ বছর পুরনো আশুলিয়ান যুগের আদিম মানুষের এটি চোয়ালের হাঁড়ের অংশবিশেষ আবিষ্কার করেন। এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন এ আবিষ্কৃত হওয়া সবচেয়ে পুরাতন মনুষ্যবিশেষ।

তানজানিয়ার ওলদুভাই গোর্জ সংস্কৃতির সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন গুরুছায় সংস্কৃতিই ছিল আজারবাইজানের নিম্ন প্যালেওলিথিক যুগের প্রধান বিষয়। এছাড়াও আভেইদা, তালার এবং দামজিলি গুহা, যার, ইয়াতাগেরি, দাস সালাখলি, কাজমা এবং অন্যান্য সাইটগুলোই প্যালেওলিথিক যুগেরই পতীক।

মধ্য প্রস্তর যুগ

আজারবাইজানের মেসোলিথিক যুগ যেটি খ্রিস্টপূর্ব ১২০০০ থেকে ৮০০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, তার নিদর্শন গুলো হচ্ছে বাকুতে অবস্থিত গোবুস্তান জাতীয় পার্ক এবং কাজাখ অঞ্চলের দামিজলি। গোবুস্তানের খোদিত পাথরগুলোই পশু শিকার, মংস্য আহরণ এবং নৃত্যকলার চিহ্ন ধারণ করে আছে। পেট্রোগ্লিপ্স প্রায় ৮-৫০০০ বছরের পূর্বের ভাইকিংসদের মত বড়ো জাহাজের চিত্র ধারণ করে যেটি ইউরোপ মহাদেশ এবং ভূমধ্যসাগরের সাথে এই অঞ্চলের মানুষদের যোগাযোগকেই নির্দেশ করে।

নব্যপ্রস্তর যুগ

খ্রিস্টপূর্ব ৭-৬০০০ অব্দের নিউলিথিক যুগ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় - আগ্সতাফা অঞ্চলের শুলাভেরি-সমু সংস্কৃতির মধ্যে যার অস্তিত্ব ছিল দামজিলি, গোবুস্তান, কুলতেপে (নাকশিভান) এবং তয়রেতেপে, এবং কৃষিতে নিউলিথিক বিপ্লব এ।

তাম্র যুগ

প্রস্তর যুগ থেকে ব্রোঞ্জ যুগে উত্তরনের সময় ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬-৪০০০ অব্দ যার নাম ছিল ক্যালকোলিথিক বা এনিওলিথিক। ককেশাস পর্বতমালার কপার আকরিকে পরিপূর্ণতা আজারবাইজানের ধাতু বিগলন শিল্পের বিস্তারে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সমুতেপ, তয়রাতেপ, জিন্নিতেপ, কুলতেপ, আলিকোমেকতেপ এবং ইলানলিতেপে অনেকগুলো শালকোলিথিক বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলোতে কার্বন ধাঁচের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় যা নির্দেশ করে যে অধিবাসীরা ঘর বানাতো, তামার সরঞ্জাম এবং শর বানাতো, সেই সাথে সেচবিহীন কৃষিকাজের সাথেও পরিচিত ছিল।

ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগ

ব্রোঞ্জ যুগের সুচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪ হাজার অব্দের দ্বিতীয় ভাগে এবং শেষ হয় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় অব্দের দ্বিতীয়ভাগে। লৌহ যুগের সূচনা হয় ৭-৬ হাজার খ্রিস্টপূর্বে। ব্রোঞ্জ যুগকে তিনভাগে ভাগ করা হয় - প্রাক, মধ্য এবং পরবর্তী, যেগুলোর অস্তিত্ব ছিল নাকশিভান, গাঞ্জা, মিংগাশেভির এবং দাশকাসান অঞ্চলে।

প্রাক-ব্রোঞ্জ যুগের প্রতীক ছিল কুরা-আরাক্সেস সংস্কৃতি এবং অলংকিত মাটির তৈজসপত্র ছিল ব্রোঞ্জ-মধ্য যুগের প্রতীক। অপরদিকে ব্রোঞ্জ-শেষ যুগের প্রতীক ছিল নাকশিভান, খোজালি-গাদাবায় এবং তালিশ-মুগান সংস্কৃতি।

১৮৯০ সালে জ্যাক দ্যা মর্গান লংকারান এর নিকটবর্তী তালিশ পর্বতে গবেষণা করে ২৩০ এর অধিক ব্রোঞ্জ-শেষ ও প্রাক-লৌহ যুগের সমাধি আবিষ্কার করেন। ই. রোসলার ও ১৮৯৪ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে কারাবাখ এবং গাঞ্জা অঞ্চলের কিছু ব্রোঞ্জ-শেষ যুগের নিদর্শন আবিষ্কার করেন। এছাড়াও জে হামেল ১৯৩০-৪১ সালের মধ্যে গয়গল এবং কারাবাখ আঞ্চলের বারোজ ১ এবং ২ অংশ এবং ব্রোঞ্জ-শেষ যুগের অন্যান্য অঞ্চলে ও গবেষণা পরিচালনা করেন।

২০১৮ সালে গোবুস্তান জাতীয় পার্কে আমেরিকার জাতীয় ইতিহাস জাদুঘর এর প্রত্নতাত্ত্বিক ওয়াল্টার ক্রিস্ট ৪০০০ বছরের পুরনো জাতের শিকারি কুকুর এবং শেয়ালের খোঁজ পান। মিশর, মেসোপটেমিয়া এবং আনাতোলিয়ার সেই সময়ের জনপ্রিয় খেলা সম্পর্কে জানা যায় মিশরের ফারাও আমেনেমহাট ৪ এর সমাধিতে।

গুলিস্তান চুক্তির পর ককেশাস, ১৮১৩

ককেশাসের আলবেনিয়ানরাই সম্ভবত আজারবাইজানের প্রথম অধিবাসি। খ্রিস্টপূর্ব ৯ শতকের শিথিয়ানরা প্রথমদিককার অনুপ্রবেশকারীদের অন্তর্গত। ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বের আশামেনিদ সাম্রাজ্য এবং আজারবাইজানে জরোস্ট্রিয়ানবাদের বিস্তারের ফলে দক্ষিণ ককেশাস এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হয়।

স্বাধীনতা লাভ

১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ১৯১৮ সালে আজারবাইজান নিজেকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে এবং এর পর আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার সাথে মিলে একটি আন্তঃককেশীয় প্রজাতন্ত্র গঠনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়।

স্বাধীন আজারবাইজানের প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মাহাম্মাদ আমিন রাসুলজেদ

১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসে আজারবাইজান মিত্রশক্তির কাছ থেকে কার্যত স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু এপ্রিল মাসে রুশ সেনাবাহিনী এই স্বাধীনতার অবসান ঘটায়। ১৯২২ সালে প্রথমে দেশটি আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অংশে পরিণত হয় এবং পরে ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে আজারবাইজানে অরাজকতা বেড়ে যায়। ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে বাকুতে এক সহিংস সংঘর্ষে সোভিয়েত সেনারা ১৯০জন জাতীয়তাবাদীকে হত্যা করে। ১৯৯১ সালের ৩০শে আগস্ট আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

তথ্যসূত্র

  1. Seyahatname by Evliya Çelebi (1611–1682)
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.