আখিরাত

আখিরাত (আরবি: الآخرة) একটি ইসলামী শব্দ যেটির দ্বারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে বোঝানো হয়।[1] মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী আখিরাত বা পরকালের জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আখিরাতে মানুষের দুনিয়ার কাজকর্মের হিসাব নেওয়া হবে এবং অতঃপর ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে।

ইসলামে আখিরাতের গুরুত্ব

আখিরাত ঈমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

“আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর আখিরাতের প্রতি তারা দৃঢ়বিশ্বাস রাখে।”[কুরআন ২:৪]

তাওহীদরিসালাতে বিশ্বাসের পাশাপাশি আখিরাতেও বিশ্বাস করা অত্যাবশ্যক। কুরআনে বলা হয়েছে,

"হে মুমিনগণ, তোমরা বিশ্বাস করো আল্লাহর প্রতি, তার রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি তার রাসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে অবতীর্ণ করেছেন। আর যে আল্লাহ, তার ফেরেশতাগণ, তার কিতাবসমূহ, তার রাসূলগণ এবং শেষ দিনকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে।"[কুরআন ৪:১৩৬]

কবর

ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর তাকে তার রব, দীন ও নবী মুহাম্মাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন করা হবে। মানুষ তাদের কর্ম অনুসারে কবরে শাস্তি বা শান্তি ভোগ করবে। মৃত ব্যক্তি কবর জীবনের শাস্তি অথবা শান্তি প্রাপ্ত হবে, যদিও তাকে ভূগর্ভস্থ করা না হয়।

কিয়ামত, পুনরুত্থান ও হাশর

কিয়ামত শব্দের অর্থ উঠে দাঁড়ানো। এটি আরবি শব্দ কিয়াম থেকে আগত যার অর্থ উঠা(ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত)। ইসলামী আকীদা অনুসারে, ইসরাফীল (আ.) শিঙ্গায় ফুৎকার দিলে কিয়ামত হবে, অর্থাৎ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে। প্রথম ফুৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহ যা জীবিত রাখবেন তাছাড়া সকল সৃষ্টজীব মারা যাবে। দ্বিতীয় ফুৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত সৃষ্টজীবের আর্বিভাব হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।[2] এরপর তাদের হিসাব-নিকাশের জন্য ময়দানে একত্রিত করা হবে। এই একত্রিত করাকে হাশর বলা হয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

"সে বলে, কে জীবিত করবে অস্থিসমূহকে যখন সেগুলো গলে পচে যাবে? বলুন, যিনি প্রথমবার সেগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই জীবিত করবেন। তিনি সর্ব প্রকার সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত।"[কুরআন ৩৬:৭৮–৭৯]

ময়দানে অবস্থানকালে সূর্য তাদের নিকটবর্তী হবে। এ উত্তপ্ত ও কঠিন অবস্থান দীর্ঘ হওয়ায় শরীর থেকে নির্গত ঘামে হাবু-ডুবু খাবে, কারো ঘাম পায়ের দু গিরা পর্যন্ত, কারো দু হাটু পর্যন্ত, কারো মাজা পর্যন্ত, কারো বক্ষ পর্যন্ত, কারো দু কাঁধ পর্যন্ত পৌঁছবে। আর কেউ-সম্পূর্ণভাবে হাবুডুবু খাবে, এসব হলো তাদের (ভালো-মন্দ) কর্ম অনুপাতে।

হাউয

আরবী শব্দ হাউয অর্থ চৌবাচ্চা পুকুর বা জলাশয়। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, মহান আল্লাহ তার নবীকে (সা.) পবিত্র হাউয দান করেছেন যেখান থেকে তার উম্মত কিয়ামতের দিন পানি পান করবে। নবীর (সা.) হাউযের পানি দুধের চেয়ে সাদা, বরফের চেয়ে ঠাণ্ডা, মধুর চেয়ে অধিক মিষ্টি। মিশকের চেয়ে সুগন্ধি, যা সুপ্রশস্ত, যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান, এর প্রতিটি প্রান্তের আয়তন এক মাসের পথের সমান। এতে জান্নাত থেকে প্রবাহিত দু’টি নালা রয়েছে। আর এর পান-পাত্র আকাশের তারকারাজির চাইতে অধিক। যে ব্যক্তি তা থেকে একবার পানি পান করবে, সে আর কখনও পিপাসার্ত হবে না।

শাফায়াত

মানুষ বিচার দিবসের ভয়াবহ বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তাদের রবের নিকট সুপারিশ পেশ করার চেষ্টা করবে। এসময় রাসূলুল্লাহ (সা.) সাজদাহ করবেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও তার মর্যাদা বর্ণনা করবেন। তারপর তিনি তার রবের নিকট সুপারিশ করার অনুমতি চাইবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে অনুমতি দিবেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) (তাদের জন্য) সুপারিশ করবেন। কিয়ামতের দিন পাপীদের ক্ষমা করা ও পুণ্যবানদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করা হবে। নবী-রাসুল, ফেরেশতা ও নেককার ব্যক্তিরা সুপারিশ করার অনুমতি পাবে। কুরআনসিয়াম সুপারিশ করবে বলেও হাদিসে উল্লেখ আছে। যে ব্যক্তিদের প্রতি স্বয়ং আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন, তাদের ছাড়া অন্য কারো জন্য কেউ সুপারিশ করবে না[3]

মীযান

কিয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে নবী মুহাম্মাদ এর উম্মাতের। সর্বপ্রথম সালাতের হিসাব নেওয়া হবে আর মানুষের মাঝে সর্বপ্রথম রক্তপাতের ফায়সালা করা হবে।

আল্লাহ বিচার দিবসে মীযান স্থাপন করবেন, বান্দাদের আমল মাপার ও তাদের কর্মের প্রতিদান প্রদানের জন্য।[4] এর দুটি পাল্লা ও রশি রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

"আর সেদিন পরিমাপ হবে যথাযথ। সুতরাং যাদের পাল্লা ভারি হবে তারাই হবে সফলকাম। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই হবে সেই সব লোক, যারা নিজদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি (অস্বীকার করার মাধ্যমে) যুলম করত।"[কুরআন ৭:৮–৯]

পুলসিরাত

মুসলিমরা পুলসিরাতে বিশ্বাস করে। আর তা হলো জাহান্নামের উপর স্থাপিত পুল, যা ভয়-ভীতি সন্ত্রস্ত পথ। এর উপর দিয়ে মানুষ জান্নাতের দিকে অতিক্রম করবে। কেউ অতি দ্রুত অতিক্রম করবে আবার কেউ অনেক ধীর গতিতে। সকলেই অতিক্রম করবে তাদের কর্মের ফলাফল অনুপাতে। পুলসিরাতের দুই ধারে হুকের মত কন্টক থাকবে, এর সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। পুলসিরাত হবে তরবারীর চেয়ে ধারালো, আর চুলের চেয়ে সূক্ষ্ম ও পিচ্ছিল জাতীয়। এতে আল্লাহ যাদের পা স্থির রাখবেন, শুধুমাত্র তাদেরই পা স্থির থাকবে, আর তা অন্ধকারে স্থাপিত হবে। জাহান্নামীদেরকে থাবা মেরে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি পুল সিরাত অতিক্রম করতে পারবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সর্বপ্রথম নবী মুহাম্মাদ অতঃপর তার উম্মাত পুলসিরাত পাড়ি দিবেন। আর সেদিন একমাত্র রাসূলগণ কথা বলবেন। রাসূলদের (আ.) কথা হবে, "হে আল্লাহ মুক্তি দাও, মুক্তি দাও"।

কানত্বারাহ

ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, মুমিনেরা পুলসিরাত অতিক্রম করে কানত্বারাতে অবস্থান করবে। আর তা (কানত্বারাহ্) হলো জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থান। এখানে জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে একে অপরের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে দাঁড় করানো হবে। অতঃপর তাদের পরিশুদ্ধির পর জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।

জান্নাত ও জাহান্নাম

মুসলিমরা বিশ্বাস করে জান্নাতজাহান্নাম সত্য এবং এ দুটি বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে, আর তা সর্বদা থাকবে। জান্নাতবাসীদের নি‘আমত শেষ হবে না, অনুরূপ জাহান্নামীদের মধ্যে যার ব্যাপারে আল্লাহ চিরস্থায়ী শাস্তির ফায়সালা করেছেন তার শাস্তি কখনও বিরত ও শেষ হবে না।

ইসলাম অনুসারে, জান্নাত হলো অতিথিশালা, যা আল্লাহ মুত্তাকীদের জন্য তৈরি করে রেখেছেন। সেখানে রয়েছে প্রবাহিত নদী, সুউচ্চ কক্ষ, মনোলোভা রমণীগণ। আরো রয়েছে এমন সব সামগ্রী যা কোনো দিন কোনো চক্ষু দেখে নি, কোনো কর্ণ শ্রবণ করে নি, আর কোনো মানুষের অন্তরেও কোনো দিন কল্পনায় আসে নি। জান্নাতের চাবুক সমতুল্য জায়গা দুনিয়া ও দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। আর জান্নাতের সুগন্ধি চল্লিশ বৎসর দূরত্বের রাস্তা থেকে পাওয়া যাবে। জান্নাতে মুমিনদের জন্য সব চাইতে বড় নি‘আমত হলো আল্লাহকে সরাসরি স্বচক্ষে দর্শন লাভ করা। জাহান্নামীরা আল্লাহর দর্শনলাভ থেকে বঞ্চিত হবে। আর জান্নাতে একশতটি ধাপ রয়েছে, এক ধাপ থেকে অপর ধাপের দূরত্ব আসমান থেকে জমিনের দূরত্ব অনুরূপ। আর সবচেয়ে উন্নত ও উত্তম জান্নাত হল, জান্নাতুল ফিরদাউস আল-আ‘লা। এর ছাদ হলো আল্লাহর ‘আরশ। আর জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে, প্রত্যেক দরজার পার্শ্বের দৈর্ঘ্য ‘মক্কা’ থেকে ‘হাজর’ এর দূরত্বের সমান। আর এমন দিন আসবে যে দিনে তা ভীড়ে পরিপূর্ণ হবে, আর জান্নাতে নূন্যতম মর্যাদার অধিকারী যে হবে তার জন্য দুনিয়া ও আরো দশ দুনিয়ার পরিমাণ জায়গা হবে।

আর জাহান্নাম হল শাস্তির ঘর যা আল্লাহ কাফির ও অবাধ্যদের জন্য তৈরি করে রেখেছেন। তার পাহারাদার হবে নিষ্ঠুর ও নির্দয় ফিরিশতারা। কাফিরদের খাদ্য হবে যাক্কুম (কাঁটাযুক্ত) আর পানীয় হবে পুঁজ, দুনিয়ার আগুনের তুলনায় ৭০ গুণ তাপমাত্রার আগুনে তাদের শাস্তি দেয়া হবে। জাহান্নামের সাতটি দরজা হবে।

তথ্যসূত্র

  1. World Faiths, teach yourself - Islam by Ruqaiyyah Maqsood. আইএসবিএন ০-৩৪০-৬০৯০১-X, pp. 38–39
  2. কুরআন ৩৯:৬৮
  3. কুরআন ২১:২৮
  4. কুরআন ২১:৪৭

আরও পড়ুন

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.