আইয়ুবীয় রাজবংশ
আইয়ুবীয় রাজবংশ (আরবি: الأيوبيون al-Ayyūbīyūn; কুর্দি: ئەیووبیەکان ,Eyûbiyan) সালাহউদ্দিন মিশরে ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে মিসরের ফাতিমীয় খিলাফতকে বিলুপ্ত করে মধ্যযুগীয় মিসরের সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি মূলতঃ কুর্দি জাতির[8][9][10][11] একটি সুন্নি মুসলিম জনগোষ্ঠী।
আইয়ুবীয় মিশরের সালাতানাত الأيوبيون ئەیووبی Eyûbî | |||||||||||||||||||||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
১১৭১–১২৬০ক/১৩৪১ | |||||||||||||||||||||||||||||||||
বামে: আইয়ুবীয় রাজবংশের পতাকা ডানে: সালাহউদ্দিনের ব্যক্তিগত নিশানার সম্পাদিত চিত্র | |||||||||||||||||||||||||||||||||
সালাহউদ্দিনের মৃত্যুর সময়ে ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুবীয় মিশরের সালতানাত (গোলাপী রঙ) | |||||||||||||||||||||||||||||||||
অবস্থা | সার্বভৌম রাষ্ট্র (১১৭১–১২৬০) | ||||||||||||||||||||||||||||||||
রাজধানী | |||||||||||||||||||||||||||||||||
প্রচলিত ভাষা | |||||||||||||||||||||||||||||||||
ধর্ম | [4] | ||||||||||||||||||||||||||||||||
সরকার | আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে সালতানাত (রাজকীয় মৈত্রী)[5] | ||||||||||||||||||||||||||||||||
সুলতান | |||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১১৭৪–১১৯৩ | সালাহউদ্দিন (প্রথম) | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১১৯৩–১১৯৮ | আজিজ | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১১৯৮–১২০০ | মানসুর | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১২০০–১২১৮ | প্রথম আদিল | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১২১৮–১২৩৮ | কামিল | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১২৩৮–১২৪০ | দ্বিতীয় আদিল | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১২৪০–১২৪৯ | সালিহ আইয়ুব | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১২৫০–১২৫০ | শাজারাতুদ দুর | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১২৫০–১২৫৪ | আশরাফ | ||||||||||||||||||||||||||||||||
ইতিহাস | |||||||||||||||||||||||||||||||||
• প্রতিষ্ঠা | ১১৭১ | ||||||||||||||||||||||||||||||||
• বিলুপ্ত | ১২৬০ক/১৩৪১ | ||||||||||||||||||||||||||||||||
আয়তন | |||||||||||||||||||||||||||||||||
১১৯০ প্রায়.[6] | ২০,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (৭,৭০,০০০ বর্গমাইল) | ||||||||||||||||||||||||||||||||
১২০০ প্রায়[7] | ১৭,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (৬,৬০,০০০ বর্গমাইল) | ||||||||||||||||||||||||||||||||
জনসংখ্যা | |||||||||||||||||||||||||||||||||
• ১২শ শতক | ৭,২০০,০০০ (প্রায়)গ | ||||||||||||||||||||||||||||||||
মুদ্রা | দিনার | ||||||||||||||||||||||||||||||||
| |||||||||||||||||||||||||||||||||
বর্তমানে যার অংশ | |||||||||||||||||||||||||||||||||
কআইয়ুবীয় রাজবংশের একটি শাখা হিসন কাইফাতে ১৬শ শতক পর্যন্ত শাসন করেছে। খ আইয়ুবি শাসকদের ভাষাসমূহের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে নিচে ধর্ম, ভাষা এবং জাতিতত্ত্ব অনুচ্ছেদ দেখুন। গআইয়ুবি সাম্রাজ্যের পূর্ণ অঞ্চলের জনসংখ্যা অজ্ঞাত। এই জনসংখ্যার হিসাবে শুধুমাত্র মিশর, সিরিয়া, উত্তর ইরাক, ফিলিস্তিন আর পূর্ব জর্ডান অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য আইয়ুবি সাম্রাজ্যের অঞ্চল ইয়েমেন, হিজায, নুবিয়া এবং পূর্ব লিবিয়া অন্তর্ভুক্ত নয়। |
পটভূমি
সালাহউদ্দিন মূলতঃ সিরিয়ার নুরুদ্দীনের অধীনে চাকরি করতেন। নুরুদ্দীনের সৈন্যদলকে ফাতিমীয় মিসরে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি উজির হিসেবে পদোন্নতি পান। নুরুদ্দীনের মৃত্যুর পর সালাহউদ্দিন নিজেকে প্রথম মিসরের সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। নিজেকে সুলতান ঘোষণা করে তিনি দ্রুতগতিতে নিজের সালতানাতের সীমানা বৃদ্ধি করতে থাকেন। মিসরের সীমান্ত পেরিয়ে পূর্বসুরী নুরুদ্দীনের ভূমিসহ লেভান্ত, হিজায, ইয়েমেন, উত্তর নুবিয়া, তারাবুলুস, বারকাহ, দক্ষিণ আনাতোলিয়া, কুর্দীদের জাতীয় ভূমি উত্তর ইরাক পর্যন্ত প্রসারিত করেন। নিজের সালতানাতকে হিজাযের অন্তর্ভুক্ত করায় তিনিই সর্বপ্রথম খাদেমুল হারামাইন শরিফাইন উপাধিটি ধারণ করেন।[12][13] (মক্কা ও মদিনার উভয় মসজিদ হিজাযের অন্তভুক্ত।) ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে আরব মুসলিম ভূমিগুলো একত্রিত করার জন্য সালাহউদ্দীনের নিজ শাসনের প্রথম দশ বছরে পরিচালনা করা সামরিক অভিযানগুলো তার সালতানাতের সাড়ে তিন শতাব্দীর জন্য সাধারণ সীমানা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরী করে দেয়। জেরুজালেম রাজ্যসহ অধিকাংশ ক্রুসেডার রাষ্ট্রসমূহ সালাহউদ্দিনের হাতেই ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে হিত্তিনের যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিল। যদিও ক্রুসেডাররা ১১৯০ এর দশকে ফিলিস্তিনের উপকূল পুনরায় দখল করে নিয়েছিল।
১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার সন্তানের সালতানাতের ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। কিন্তু সালাহউদ্দিনের ভাই প্রথম আদিল ১২০০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হন। পরবর্তী সকল আইয়ুবীয় সুলতানরা তারই বংশধর ছিলেন। ১২৩০ এর দশকে সিরিয়ার আমিররা মিসর এবং আইয়ুবীয় রাজত্ব থেকে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ১২৪৭ খ্রিস্টাব্দে সালিহ আইয়ুব আলেপ্পো ব্যতীত সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকা দখল করে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে ততদিনে ইয়েমেন, হিজায আর মেসোপটেমিয়ার কিছু অংশের স্থানীয় রাজবংশের লোকেরা সেসব অঞ্চল থেকে আইয়ুবীয়দের ক্ষমতা লুপ্ত করেছিল। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে সালিহ আইয়ুবের মৃত্যুর পর তার সন্তান মুয়াজ্জম তুরানশাহ তার উত্তরসূরী নির্বাচিত হন। কিন্তু সামান্য কিছুদিন পরেই তাকে তার মামলুক জেনারেলরা উৎখাত করেন। তারা তখন নীল বদ্বীপে ক্রুসেডারদের আক্রমণকে প্রতিহত করেছিল। এই ঘটনা মিশরের কার্যকরী আইয়ুবীয় ক্ষমতা শেষ করে দেয়। আলেপ্পোর আমির নাসির ইউসুফের নেতৃত্বে সিরিয়ার আমিরদের একটি দল মিশরকে আইয়ুবীয়দের অধীনে রাখার চেষ্টা করলেও সেটা ব্যর্থ হয়। ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গোলরা আলেপ্পো দখল করে নেয় এবং খুব দ্রুতই আইয়ুবীয়দের বাকি থাকা অঞ্চলগুলোও দখলে নিয়ে নেয়। কিন্তু খুব দ্রুতই মামলুকরা সেসব অঞ্চল মঙ্গোলদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেয়। শুধুমাত্র হামায় ১৩৪১ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুবীয়দের পদত্যাগের আগপর্যন্ত সেখানে মামলুক কর্তৃক আইয়ুবীয়দের ক্ষমতা বজায় থাকে।
খুব কম সময় রাজত্ব করলেও আইয়ুবীয়রা এই অঞ্চলে খুব পরিবর্তনমূলক প্রভাব ফেলেছিল। তাদের রাজত্বের পূর্বে মিশর ফাতেমীয়দের অধীনে শিয়াদের খিলাফত হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কর্তৃত্বে ছিল। কিন্তু আইয়ুবীয়দের ক্ষমতাগ্রহণের পরে মিশর প্রভাবশালী সুন্নী রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠে। এছাড়া পুরো আরবের, বরং মুসলিম সাম্রাজ্যসমূহে এটি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে যায়। আইয়ুবীয় শাসন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির যুগের সূচনা করে। তাদের প্রদত্ত সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় সুন্নী মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপের পুনরায় উত্থানের সূচনা হয়। এই সংক্ষিপ্ত সময়েই তাদের প্রধান শহরগুলোতে অসংখ্য মাদরাসা নির্মাণের মাধ্যমে তারা এই অঞ্চলে সু্ন্নী মুসলিমদের আধিপত্যকে জোরালোভাবে শক্তিশালী করে। তারা এমন সম্মানের একটি জায়গা হিসেবে মিশরকে প্রতিষ্ঠা করেছিল যে, মামলুকদের হাতে তাদের পতনের পরও তাদের সীমানা করে দেয়া সালতানাত আরো ২৬৭ বছর মিশর, লেভান্ত, হিজায এবং ইয়েমেনে মিশর সালতানাতের ক্ষমতা বজায় থাকে। শেষপর্যন্ত ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয়দের হাতে মামলুকদের পতন ঘটলে মিশর তার প্রাধান্য হারায়।
সালাহউদ্দিন জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে প্রধান কৃতিত্ব রাখেন। ক্রুসেডাররা এই বিজয়ের ৯৯ বছর পূর্বে খোদ মিশর শহর পর্যন্ত দখল করে ফেলেছিল। এত শক্তিশালী রাজ্যকে বিজয় করার জন্য সালাহউদ্দীনকে তার সালতানাতের অধীন ছিল এমন বর্তমান দেশগুলোতে বর্তমান সময়েও জাতীয় বীর হিসেবেই পরিচিত। বিশেষতঃ মিশর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন আর তার জন্মভূমি ইরাকে। সিরিয়া বাদে উল্লেখিত প্রতিটি দেশই তার আভিজাতিক ঈগলকে তাদের জাতীয় কোট অব আর্মস হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
ইতিহাস
উদ্ভব
আইয়ুবীয় রাজবংশের পূর্বপুরুষ নাজমুদ্দিন আইয়ুবের পিতা শাযী কুর্দী রাওয়াদিয়া গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রাওয়াদিয়া গোত্র হাযাবানি গোত্রের অন্তর্গত ছিল।[14] আইয়ুবের পূর্বপুরষরা উত্তর আর্মেনিয়ার দাবিল বা দিভিন শহরে বসতি স্থাপন করেছিলেন।[8]রাওয়াদিয়ারা দিভিন শহরে প্রভাবশালী কুর্দী গোষ্ঠী হিসেবেই প্রসিদ্ধ ছিল। তারা রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাতদের অংশ ছিল। তুর্কী জেনারেলরা দিভিন শহর কুর্দী রাজা থেকে দখলে নিয়ে নিলে শহরের পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যায়। শাযী তার পুত্র আইয়ুব ও আসাদুদ্দীন শিরকুহকে সাথে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েন।[15] সেলজুকদের পক্ষ থেকে উত্তর মেসোপটেমিয়ার সামরিক শাসক মুজাহিদুদ্দীন বেহরোজ তার বন্ধু ছিলেন। তিনি শাযীকে আমন্ত্রণ করেন এবং তিকরিতের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। শাযীর মৃত্যুর পর তার সন্তান আইয়ুব শহরের শাসনে তার উত্তরাধিকার হিসেবে নিযুক্ত হন, আর তার ভাই শিরকুহ তার সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান। তারা দুই ভাই মিলে শহরের বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে সমাধান করেন। এরফলে তারা খুব দ্রুতই শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।[16] এরমধ্যে একটি যুদ্ধে মসুলের শাসক ইমাদউদ্দিন জেনগি আব্বাসীয় খলীফা মুসতারশিদ ও বেহরুজের কাছে পরাজিত হন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণের সময়ে জেনগি তিকরিত হয়ে মসুল পৌঁছার চিন্তা করেন। তিনি আইয়ুবের কাছে এইকাজে সহায়তা ও নিরাপত্তা চান। আইয়ুব তাকে সহায়তা করেন এবং দজলা নদীতে নৌকায় করে তাকে নিরাপদে মসুল পৌঁছে দেন।[17]
জেনগিকে সহায়তা করার অভিযোগে আব্বাসীয় কর্তৃপক্ষ আইয়ুবের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা করে। এদিকে আরেকটি ভিন্ন ঘটনায় বেহরুজের সাথেও তার ভাইয়ের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি এমন, বেহরুজের একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি একজন মহিলাকে যৌন নির্যাতন করেছিল। যার ফলে শিরকুহ তাকে হত্যা করেন। এই উভয় ঘটনার প্রভাবে আব্বাসীয় দরবার থেকে আইয়ুব এবং শিরকুহ উভয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু তারা গ্রেফতার হবার আগেই তিকরিত থেকে পলায়ন করে মসুল চলে যান। এই ঘটনা ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দের।[18] তারা মসুল পৌঁছলে জেনগি তাদের সকল বন্দোবস্ত করে দেন। তাদেরকে নিজের কাজে নিযুক্ত করে দেন। আইয়ুব বালবেকের সেনাপতি নিযুক্ত হন আর শিরকুহকে জেনগির পুত্র নুরউদ্দিনের বাহিনীতে যুক্ত করা হয়। ইতিহাসবিদ আবদুল আলীর মতে, জেনগি পরিবারের তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই আইয়ুবীয় পরিবার প্রসিদ্ধি লাভ করে।[18]
মিশরে প্রতিষ্ঠা
১১৬৪ খ্রিস্টাব্দে নুরউদ্দিন নৈরাজ্যপূর্ণ মিশরে ক্রুসেডারদের শক্ত অবস্থান তৈরিতে বাঁধা দেয়ার জন্য শিরকুহকে একটি বাহিনীসহ প্রেরণ করেন। শিরকুহ তখন আইয়ুবপুত্র সালাহউদ্দিনকে একজন কমান্ডিং অফিসার হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন।[19] তারা সফলভাবে মিশরের উজির দিরগামকে পরাজিত করেন এবং তার পূর্বসূরী শাওয়ারকে পুনঃস্থাপিত করেন। শাওয়ার শিরকুহকে সেনাবাহিনী নিয়ে মিশর ছেড়ে যেতে বলেন। কিন্তু শিরকুহ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, যতক্ষণ নুরউদ্দিন চাইবেন তিনি অবস্থান করবেন।[20] এইকারণে পরবর্তী কয়েক বছরে শিরকুহ এবং সালাহউদ্দিনকে ক্রুসেডার ও শাওয়ারের সংযুক্ত বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়। প্রথমে বিলবাইসে, তারপর গিজার নিকটবর্তী একটি ভূমিতে এরপর আলেকজান্দ্রিয়ায় তারা উভয় বাহিনীকে পরাজিত করেন। শিরকুহ মিশরের নিম্নভূমিতে ক্রুসেডারদের প্রতিহত করতে গিয়েছিলেন, যখন সালাহউদ্দিন তাকে রক্ষা করতে আলেকজান্দ্রিয়ায় লড়াই করেন।[21]
শাওয়ার ১১৬৯ সালে মারা যান এবং শিরকুহ উজির হন, কিন্তু তিনিও সেই বছর পরে মারা যান।[22] মধ্যযুগীয় মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনুল আসিরের মতে, শিরকুহের মৃত্যুর পর, ফাতেমীয় খলিফা আল-আদিদ সালাহউদ্দিনকে উজির নিযুক্ত করেছিলেন কারণ সালাহউদ্দিনের চেয়ে "দুর্বল বা ছোট কেউ ছিল না" এবং "একজনও আমির তাকে মান্য করেনি বা তার সেবা করেনি"।[23] সালাহউদ্দিন তার কর্মজীবনে শীঘ্রই নিজেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন মনে করেন, অনেকটা নুরুদ্দিনের জন্য হতাশার কারণ যিনি মিশরের ঘটনাগুলোকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সালাহউদ্দিনের বড় ভাই তুরান শাহকে আইয়ুবীয় পরিবারের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে এবং এইভাবে মিশরে তার অবস্থানকে ক্ষুণ্ন করার জন্য সালাহউদ্দিনের তত্ত্বাবধানের অনুমতি দেন। নুরুদ্দিন সালাহউদ্দিনের অনুরোধে সন্তুষ্ট হন যে, তিনি তার পিতা আইয়ুবকে তার সাথে যোগ দিতে অনুমতি দেন। যাইহোক, আইয়ুবকে প্রাথমিকভাবে মিশরে আব্বাসিদের আধিপত্য ঘোষণা করা হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য পাঠানো হয়েছিল, যেটি ফাতেমিদের উজির হিসাবে তার অবস্থানের কারণে সালাহউদ্দিন গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। যদিও নুরুদ্দিন আইয়ুবীয়দের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বর্ধিত আইয়ুবীয় পরিবারের কারণে উস্কে দিতে ব্যর্থ হন। তবে সিরিয়ার স্থানীয় গভর্নররা সালাহউদ্দিনকে পুরোপুরি সমর্থন করেননি।[24]
তুরান শাহকে ফাতেমীয় সেনাবাহিনীর পঞ্চাশ হাজার শক্তিশালী নুবিয়ান রেজিমেন্ট দ্বারা পরিচালিত কায়রোতে বিদ্রোহ দমন করার জন্য আদেশ দিয়ে সালাহউদ্দিন মিশরে তার নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করেন। এই সাফল্যের পর সালাহউদ্দিন তার পরিবারের সদস্যদের দেশে উচ্চ-পদস্থ পদ প্রদান করা শুরু করেন এবং শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত কায়রোতে সুন্নি মুসলিম প্রভাব বৃদ্ধি করেন। শহরে সুন্নি ইসলামের আইনশাস্ত্রের মালিকি মাযহাবের জন্য একটি মাদরাসা নির্মাণের আদেশ দেন, এবং আরেকটি ফুসতাতে শাফিঈ মাযহাবের জন্য মাদরাসা নির্মাণ করেন। তিনি নিজে শাফিঈ ছিলেন। ১১৭১ সালে আল আদিদ মারা যান এবং সালাহউদ্দিন এই ক্ষমতার শূন্যতার সুযোগ নিয়ে কার্যকরভাবে দেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ক্ষমতা দখলের পর তিনি বাগদাদ-ভিত্তিক আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি মিশরের আনুগত্য পরিবর্তন করেন যেটি সুন্নি ইসলামকে মেনে চলে।[25]
উত্তর আফ্রিকা ও নুবিয়া বিজয়
সালাহউদ্দিন ১১৭১-৭২ সালে আলেকজান্দ্রিয়ায় গিয়েছিলেন এবং শহরে অনেক সমর্থক, কিন্তু সামান্য অর্থের কারণে নিজেকে সঙ্কটের সম্মুখীন হতে দেখেছিলেন। মিশরের আইয়ুবী আমীরদের দ্বারা সেখানে একটি পারিবারিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে সালাহউদ্দিনের ভ্রাতুষ্পুত্র মুযাফফর তাকিউদ্দিন উমর ৫০০ সৈন্য নিয়ে মিশরের পশ্চিমে বারকা (সাইরেনিকা) উপকূলীয় অঞ্চলের বিরুদ্ধে একটি অভিযান শুরু করবেন। অশ্বারোহী অভিযানের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য বারকার বেদুইন উপজাতিদের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছি।, তাদের যাত্রীদের ডাকাতির জন্য তাদের তিরস্কার করা হয়েছিল এবং তাদের কর (যাকাত) প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে সেটি তাদের পশুসম্পদ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।[26]
১১৭২ সালের শেষের দিকে নুবিয়ার প্রাক্তন ফাতিমি সৈন্যদের দ্বারা আসওয়ান অবরোধ করা হয়েছিল এবং শহরের গভর্নর কানযুদ্দৌলা; যিনি একজন প্রাক্তন ফাতিমীয় অনুগত ছিলেন, তিনি সালাহউদ্দিনের নিকট শক্তিবৃদ্ধির অনুরোধ করেছিলেন। সালাহউদ্দিন তার অনুরোধ গ্রহণ করেন। নুবিয়ানরা আসওয়ান ত্যাগ করার পরে শক্তিবৃদ্ধি এসেছিল, কিন্তু তুরান শাহের নেতৃত্বে আইয়ুবীয় বাহিনী ইব্রিম শহর দখল করার পরে উত্তর নুবিয়ার দিকে অগ্রসর হয় এবং সেটি জয় করে। তুরান শাহ এবং তার কুর্দি সৈন্যরা সেখানে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করে। ইব্রিম থেকে তারা আশেপাশের অঞ্চলে অভিযান চালায়। ডঙ্গোলা-ভিত্তিক নুবিয়ান রাজার কাছ থেকে একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পেশ করার পরে তাদের অভিযান কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। যদিও তুরান-শাহ-এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল যুদ্ধ বন্ধ করার বিরোধী। কিন্তু পরে তিনি ডোঙ্গোলায় একজন দূত পাঠান, যিনি ফিরে তুরান-শাহকে সাধারণভাবে শহর এবং নুবিয়ার দারিদ্র্যের বর্ণনা দেন। ফলস্বরূপ আইয়ুবীয়রা তাদের ফাতেমীয় পূর্বসূরিদের মত এই অঞ্চলের দারিদ্র্যতার কারণে নুবিয়ার আরও দক্ষিণমুখী অভিযান থেকে নিরুৎসাহিত হয়েছিল। কিন্তু আসওয়ান এবং উচ্চ মিশরের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে নুবিয়ার প্রয়োজন ছিল।[27] ১১৭৫ সালে ইব্রিমের আইয়ুবীয় গ্যারিসন মিশরে প্রত্যাহার করে।[28]
১১৭৪ সালে মুযাফফর উমরের অধীনে একজন সেনাপতি শরফুদ্দিন কারাকুশ তুর্কি ও বেদুইনদের একটি সেনাবাহিনী নিয়ে নরম্যানদের কাছ থেকে ত্রিপোলি জয় করেন।[26][29] পরবর্তীকালে যখন কিছু আইয়ুবী বাহিনী শামে ক্রুসেডারদের সাথে যুদ্ধ করেছিল, তখন তাদের আরেকটি বাহিনী শরফুদ্দিনের অধীনে ১১৮৮ সালে আলমোহাদদের কাছ থেকে কাইরুয়ানের নিয়ন্ত্রণ দখল করে।[26]
আরব বিজয়
১১৭৩ সালে, সালাহউদ্দিন তুরান শাহকে ইয়েমেন এবং হেজাজ জয় করতে পাঠান। মুসলিম লেখক ইবনুল আসির এবং পরবর্তীকালে মাকরিজি লিখেছেন যে, ইয়েমেন বিজয়ের পিছনে যুক্তি ছিল একটি আইয়ুবীয়দের ভয় ছিল যে মিশর যদি নুরুদ্দিনের হাতে পড়ে, তাদেরকে দূরবর্তী অঞ্চলে আশ্রয় নিতে হতে পারে। ১১৭৪ সালের মে মাসে তুরান শাহ জাবিদ জয় করেন এবং সেই বছরই এডেন দখল করেন।[30] এডেন ভারত মহাসাগরে রাজবংশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর এবং ইয়েমেনের প্রধান শহর হয়ে ওঠে,[31] যদিও আইয়ুবীয় ইয়েমেনের সরকারী রাজধানী ছিল তাইজ।[32] আইয়ুবীয়দের আবির্ভাব শহরে নতুন করে সমৃদ্ধির সময়কালের সূচনা করে যা এর বাণিজ্যিক অবকাঠামোর উন্নতি, নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা এবং নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করে।[31] এই সমৃদ্ধির পরে আইয়ুবীরা একটি নতুন কর কার্যকর করে যা গ্যালি নৌকা দ্বারা সংগ্রহ করা হয়েছিল।[33]
তুরান শাহ ১১৭৫ সালে সানার পাহাড়ী শহর জয় করে বাকি থাকা হামদানী শাসকদের তাড়িয়ে দেন।[30] ইয়েমেন বিজয়ের সাথে সাথে আইয়ুবীয়রা একটি উপকূলীয় নৌবহর তৈরি করেছিল। আসাকিরুল বাহরিয়া নামে, যেটি তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সমুদ্র উপকূলগুলোকে পাহারা দিতে এবং জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ব্যবহার করেছিল।[34] ইয়েমেন বিজয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল কারণ আইয়ুবীয়রা পূর্ববর্তী তিনটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রকে (জাবিদ, এডেন এবং সানা) একক শক্তির অধীনে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিল। যাইহোক, যখন তুরান শাহকে ১১৭৬ সালে ইয়েমেনে তার গভর্নর পদ থেকে বদলি করা হয়, তখন এই অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ১১৮২ সাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহ প্রশমিত হয়নি। অবশেষে ১১৮২ সালে সালাহউদ্দিন তার অন্য ভাই তুগতেকিন সাইফুল ইসলামকে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করার পর বিদ্রোহের নিষ্পত্তি হয়।[30] ইয়েমেনের আইয়ুবীয় নায়েব (ডেপুটি গভর্নর) উসমান জান্দজিলি তুরান শাহ ইয়েমেনে ফিরে আসার পর ১১৮০ সালে হাদরামাউতের বৃহত্তর অংশ জয় করেন।[35]
ইয়েমেন থেকে, আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে মিশর থেকে, আইয়ুবীয়দের লক্ষ্য ছিল লোহিত সাগরের বাণিজ্য পথগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করা যার উপর মিশর নির্ভর করে এবং তাই হেজাজের উপর তাদের দখল শক্ত করার চেষ্টা করেছিল, যেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যবন্দর ইয়ানবু অবস্থিত ছিল।[36] লোহিত সাগরের দিকে বাণিজ্যে সুবিধা করতে, আইয়ুবীরা বণিকদের সাথে লোহিত সাগর-ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য রুট বরাবর সুবিধা তৈরি করেছিল।[37] আইয়ুবীয়রা ইসলামের পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনার উপরও সার্বভৌমত্বের মাধ্যমে খিলাফতের মধ্যে বৈধতার দাবিকে সমর্থন করতে চেয়েছিল।[36] সালাহউদ্দিন কর্তৃক গৃহীত বিজয় এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি কার্যকরভাবে এই অঞ্চলে মিশরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।[37]
সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়া বিজয়
যদিও তখনও নুরুদ্দিনের একজন সামন্ত ছিলেন, কিন্তু সালাহউদ্দিন একটি ক্রমবর্ধমান স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ১১৭৪ সালে নুরুদ্দিনের মৃত্যুর পর এই স্বাধীনতা আরও প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়।[38] এরপরেই সালাহউদ্দিন জেনগিদের কাছ থেকে সিরিয়া জয় করতে রওনা হন এবং ২৩ নভেম্বর তাকে শহরের গভর্নর দামেস্কে স্বাগত জানান। ১১৭৫ সাল নাগাদ তিনি হামা এবং হিমসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন, কিন্তু আলেপ্পো অবরোধ করার পর দখল করতে ব্যর্থ হন।[39] হিমসের নিয়ন্ত্রণ ১১৭৯ সালে শিরকুহের বংশধরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল এবং হামা সালাহউদ্দিনের ভ্রাতুষ্পুত্র মুযাফফর উমরকে দেওয়া হয়েছিল।[40] সালাহউদ্দিনের সাফল্য সে সময় জেনগিদের প্রধান মসুলের আমির সাইফুদ্দিনকে শঙ্কিত করেছিল, যিনি সিরিয়াকে তার পরিবারের সম্পত্তি হিসাবে বিবেচনা করতেন। তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, সিরিয়া নুরুদ্দিনের একজন প্রাক্তন কর্মচারী দ্বারা দখল করা হচ্ছে। হামার কাছে সালাহউদ্দিনের মোকাবিলা করার জন্য তিনি একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন। যদিও তার সৈন্যদল সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল, কিন্তু সালাহউদ্দিন এবং তার প্রবীণ সৈন্যরা সিদ্ধান্তমূলকভাবে জেনগিদের পরাজিত করেছিল।[39] বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন এবং জুমার নামাজে এবং ইসলামি মুদ্রায় সালিহ ইসমাইল মালিক (নুরুদ্দিনের কিশোর পুত্র) নামের পরিবর্তে তার নিজের নাম দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন। আব্বাসীয় খলিফা আল মুস্তাদি সদয়ভাবে সালাহউদ্দিনের ক্ষমতা গ্রহণকে স্বাগত জানান এবং তাকে "মিশর ও সিরিয়ার সুলতান" উপাধি দেন।[41]
১১৭৬ সালের বসন্তে জেনগি এবং আইয়ুবীয়দের মধ্যে আরেকটি বড় সংঘর্ষ ঘটে। এবার সুলতান পর্বতের কাছাকাছি একটি গ্রামে, যেটি আলেপ্পো থেকে ১৫ কিলোমিটার (৯.৩ মা) দূরে। সালাহুদ্দিন আবারও বিজয়ী হন, কিন্তু সাইফুদ্দিন গাজি অল্পের জন্য পালাতে সক্ষম হন। আইয়ুবীয়রা উত্তরে সিরিয়ার অন্যান্য শহর যেমন মারাতুন নুমান, আজাজ, বুজা এবং মানবিজ জয় করতে অগ্রসর হয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয় অবরোধের সময় আলেপ্পো দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। যদিও একটি চুক্তি করা হয়েছিল। যেখানে আলেপ্পোর গভর্নর গুমুশতিগিন এবং হিসনে কাইফা এবং মারদিনে তার সহযোগীরা সালাহুদ্দিনকে সিরিয়ায় আইবীয়দের রাজত্বের সার্বভৌম হিসাবে স্বীকৃতি দেবে। চুক্তি মোতাবেক সালাহুদ্দিন গুমুশতিগিন এবং সালিহ মালিককে আলেপ্পোতে তাদের শাসন অব্যাহত রাখতে অনুমতি দিয়েছিলেন।[42]
সালাহুদ্দিন সিরিয়ায় থাকাকালীন তার ভ্রাতা আদিল মিশর শাসন করছিলেন।[43] ১১৭৪-৭৫ সালে আসওয়ানের কানযুদ দাওলা ফাতিমীয় শাসন পুনরুদ্ধারের চিন্তায় আইয়ুবীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তার পিছনে শক্তির যোগান দিচ্ছিল স্থানীয় বেদুঈন ও নুবিয়ানরা৷ এছাড়াও তারা আর্মেনীয়সহ অন্যান্য অনেক গোষ্ঠীর সহায়তা পেয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে বা সম্ভবত সমন্বয় করেই আব্বাস বিন শাদি একইসময়ে নীলনদের পাশে কুস শহরের পুরোভাগে বিদ্রোহ শুরু করেন। কিন্তু আদিল উভয় বিদ্রোহই পর্যদুস্ত করেন।[44] সেই বছরের বাকি সময় এবং ১১৭৬ সালের গোড়ার দিকে, কারাকুশ পশ্চিম উত্তর আফ্রিকায় তার অভিযান চালিয়ে যান, যা মাগরেব শাসনকারী মুওয়াহহিদিনদের সাথে আইয়ুবীয়দের সংঘাতের মধ্যে নিয়ে আসে।[26]
১১৭৭ সালে সালাহুদ্দিন প্রায় ২৬,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ক্রুসেডার ঐতিহাসিক উইলিয়াম অফ টায়ারের মতে, জেরুজালেমের রাজ্যের বেশিরভাগ সৈন্যরা আলেপ্পোর পশ্চিমে সিরিয়ার হারেম অবরোধ করছে শুনে সালাহুদ্দিন তার সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ ফিলিস্তিনে নিয়ে আসেন। রমলার কাছে জেরুজালেমের চতুর্থ বাল্ডউইনের অধীনে টেম্পলারদের দ্বারা আকস্মিক আক্রমণে আইয়ুবীয় সেনাবাহিনী মন্টগিসার্ডের যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং তাদের বেশিরভাগ সৈন্য নিহত হয়। পরের বছর সালাহুদ্দিন হিমসে শিবির স্থাপন করেন এবং ফররুখ শাহের নেতৃত্বে তার বাহিনীর সাথে ক্রুসেডারদের বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ হয়।[45] নিরুৎসাহিত হয়ে, সালাহুদ্দিন পশ্চিম থেকে ক্রুসেডার রাজ্যগুলিতে আক্রমণ করেছিলেন এবং ১১৭৯ সালে মারজ আইয়ুনের যুদ্ধে বাল্ডউইনকে পরাজিত করেছিলেন। পরের বছর, তিনি জ্যাকবের ফোর্ডের যুদ্ধে চ্যাস্টলেটের নবনির্মিত ক্রুসেডার দুর্গ ধ্বংস করেন। ১১৮২ সালের যুদ্ধের অভিযানে, কাওকাবুল হাওয়াতে বেলভোয়ার দুর্গের অনিয়মিত যুদ্ধে তিনি আবার বাল্ডউইনের সাথে লড়াই করেছিলেন।[46]
১১৮২ সালের মে মাসে সালাহুদ্দিন একটি সংক্ষিপ্ত অবরোধের পর আলেপ্পো দখল করেন। শহরের তৎকালীন নতুন গভর্নর দ্বিতীয় ঈমাদুদ্দিন জেনগি তার প্রজাদের কাছে অজনপ্রিয় ছিলেন। তিনি আলেপ্পো সমর্পণ করেন যখন সালাহদিন সিনজার, রাক্কা এবং নুসাইবিনের উপর দ্বিতীয় জেনগির পূর্বের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সম্মত হন। জেনগির এলাকাগুলো পরবর্তীতে আইয়ুবীয়দের অধীনস্থ অঞ্চল হিসাবে কাজ করে।[47] আলেপ্পো আনুষ্ঠানিকভাবে ১২ জুন আইয়ুবীয়দের দখলে আসে। পরের দিন, সালাহুদ্দিন ক্রুসেডার-নিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিওকের কাছে হারিমের দিকে অগ্রসর হন এবং শহরটি দখল করেন। হারিমের গ্যারিসন তাদের নেতা সুরহাককে জোরপূর্বক বহিষ্কার করে, যাকে তখন মুযাফফরর উমর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আটক করে ছেড়ে দেন।[48] আলেপ্পোর আত্মসমর্পণ এবং দ্বিতীয় জেনগির সালাহুদ্দিনের প্রতি আনুগত্যের পর মসুলের ইযযুদ্দিন মাসউদ আইয়ুবীয়দের একমাত্র প্রধান মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাকি থাকেন। ১১৮২ সালের শরৎকালে মসুল একটি সংক্ষিপ্ত অবরোধের শিকার হয়েছিল, কিন্তু আব্বাসীয় খলিফা নাসিরের মধ্যস্থতার পর, সালাহুদ্দিন তার বাহিনী প্রত্যাহার করে নেন। মাসউদ নিজেকে মার্দিনের আর্তুকিদের সাথে সারিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। আর্তুকিদরা মাসউদের পরিবর্তে সালাহুদ্দিনের মিত্র হয়েছিলেন। ১১৮৩ সালে আরবিলও আইয়ুবীয়দের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তন করে। মাসউদ তখন আজারবাইজানের গভর্নর পাহলাওয়ান ইবনে মুহাম্মদের সমর্থন চেয়েছিলেন এবং যদিও তিনি সাধারণত এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করেন না, পাহলাওয়ানের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সালাহুদ্দিনকে মসুলের বিরুদ্ধে আরও আক্রমণ শুরু করার বিষয়ে সতর্ক করে তোলে।[49]
আদিল আলেপ্পো সালাহুদ্দিনের ছেলে আফযালের নামে আর মুযাফফর উমর মিশর সালাহুদ্দিনের অন্য ছেলে আজিজ উসমানের নামে এই শর্তের সাথে শাসন করেন যে, দুই ছেলের বয়স হলে তারা দুই অঞ্চলের ক্ষমতা গ্রহণ করবে, কিন্তু কেউ মারা গেলে সালাহুদ্দিনের ভাইদের একজন তাদের জায়গা নেবে।[50] ১১৮৩ সালের গ্রীষ্মে, পূর্ব গালীলে ধ্বংসযজ্ঞের পর, সেখানে সালাহুদ্দিনের অভিযানের সমাপ্তি ঘটে জেজরিল উপত্যকায় আল-ফুলের যুদ্ধে তার এবং লুসিগনানের গাইয়ের অধীনস্থ ক্রুসেডারদের মধ্যে। বেশিরভাগ হাতে হাতে লড়াই সিদ্ধান্তহীনতায় শেষ হয়েছিল। দুই বাহিনী একে অপরের থেকে এক মাইল দূরে সরে যায় এবং ক্রুসেডাররা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা করার সময়, সালাহুদ্দিন গোলান মালভূমি দখল করে, ক্রুসেডারদের তাদের প্রধান সরবরাহের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে। ১১৮৩ সালের অক্টোবরে এবং তারপর ১৩ আগস্ট ১১৮৪ সালে সালাহুদ্দিন এবং আদিল ক্রুসেডার-নিয়ন্ত্রিত কারাক অবরোধ করেন, কিন্তু তা দখল করতে পারেননি। পরবর্তীতে, আইয়ুবিদরা শমরিয়া আক্রমণ করেন, নাবলুস পুড়িয়ে দেন। সালাহুদ্দিন ১১৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে দামেস্কে ফিরে আসেন এবং পরবর্তীকালে ১১৮৪-১১৮৫ সালে ক্রুসেডার রাজ্য এবং আইয়ুবী সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি আপেক্ষিক শান্তিচুক্তি ঘটে।[51]
সালাহুদ্দিন ১১৮৫ সালের শেষের দিকে মসুলের বিরুদ্ধে তার শেষ আক্রমণ শুরু করেন, সম্ভবতঃ নিরাশ মাসউদের বিরুদ্ধে সহজ জয়ের আশায়। কিন্তু শহরের অপ্রত্যাশিতভাবে কঠোর প্রতিরোধ এবং একটি গুরুতর অসুস্থতার কারণে ব্যর্থ হন; যার কারণে সালাহুদ্দিন হারানে ফিরে যান। আব্বাসিদের উৎসাহে সালাহুদ্দিন এবং মাসউদ ১১৮৬ সালের মার্চ মাসে একটি চুক্তিতে আলোচনা করেন যার ফলে মসুল জেনগিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, কিন্তু অনুরোধ করা হলে আইয়ুবীয়দের সামরিক সহায়তা প্রদানের বাধ্যবাধকতা ছিল।[52]
তথ্যসূত্র
- Magill 1998, পৃ. 809
- France 1998, পৃ. 84
- Ahmed, Rumee (২৫ অক্টোবর ২০১৮)। The Oxford Handbook of Islamic Law। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 311। আইএসবিএন 978-0-19-166826-5। ৬ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জানুয়ারি ২০২২।
- Eliade, Mircea (১৯৮৭)। "Kalam"। The Encyclopedia of Religion। 8: 238। আইএসবিএন 978-0-02-909790-8।
- Jackson 1996, p. 36
- Turchin, Adams এবং Hall 2006, পৃ. 223
- Taagepera 1997, পৃ. 495।
- Humphreys 1987
- Özoğlu 2004, পৃ. 46
- Bosworth 1996, পৃ. 73
- Jackson 1996, পৃ. 36।
- Fakkar, Galal (২৭ জানুয়ারি ২০১৫)। "Story behind the king's title"। Arab News। Jeddah। ৪ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ জুন ২০১৬।
- Eiselen 1907, পৃ. 89
- The biographer Ibn Khallikan wrote, "Historians agree in stating that [Saladin's] father and family belonged to Duwin. … They were Kurds and belonged to the Rawādiya [sic], which is a branch of the great tribe al-Hadāniya": Minorsky (1953), p. 124.
- Humphreys 1987
- Ali 1996, পৃ. 27
- Ali 1996, পৃ. 28
- Ali 1996, পৃ. 28
- Shillington 2005, পৃ. 438
- Lyons ও Jackson 1982, পৃ. 8
- Lyons ও Jackson 1982, পৃ. 14
- Lyons ও Jackson 1982, পৃ. 25
- Lyons ও Jackson 1982, পৃ. 28
- Lev 1999, পৃ. 96–97
- Shillington 2005, পৃ. 438
- Lev 1999, পৃ. 101
- Lev 1999, পৃ. 100
- Fage 1978, পৃ. 583
- Lane-Poole 1894, পৃ. 75
- Houtsma ও Wensinck 1993, পৃ. 884
- Margariti 2007, পৃ. 29
- McLaughlin 2008, পৃ. 131
- Lofgren 1960, পৃ. 181
- Dumper ও Stanley 2007, পৃ. 10
- Brice 1981, পৃ. 338
- Salibi 1998, পৃ. 55
- Daly ও Petry 1998, পৃ. 217–218
- Shillington 2005, পৃ. 438
- Lane-Poole 1906, পৃ. 141
- Lane-Poole 1894, পৃ. 76
- Lane-Poole 1906, পৃ. 142–146
- Lane-Poole 1906, পৃ. 146–148
- Lev 1999, পৃ. 22
- Lev 1999, পৃ. 100–101
- Lane-Poole 1906
- Smail 1995
- Lyons ও Jackson 1982
- Lyons ও Jackson 1982
- Humphreys 1991
- Lyons ও Jackson 1982
- Lane-Poole 1906
- Humphreys 1991