অশ্বমেধ যজ্ঞ

অশ্বমেধ (সংস্কৃত: अश्वमेध) হচ্ছে বৈদিক ধর্মের শ্রৌত ঐতিহ্য অনুসারে গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় যজ্ঞ অনুষ্ঠানগুলির একটি। প্রাচীন ভারতে রাজারা তাদের সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব নতুনত্বকরণের জন্য এই বৈদিক যজ্ঞের আয়োজন করতেন। সাম্রাজ্যের প্রসার, ক্ষমতা ও গৌরব অর্জন, প্রতিবেশী সাম্রাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা হল যজ্ঞের উদ্দেশ্য। এই যজ্ঞে সাম্রাজ্যের প্রসারের জন্য যজ্ঞনিয়ম অনুসারে একটি বলবান অশ্বকে পৃথিবী ভ্রমণের জন্য মুক্ত করা হয়। অশ্ব যে যে স্থানে গমন করে, যজ্ঞকারী সেই স্থান অধিকার করেন। অশ্বকে কোনো নরপতি আটক করলে অশ্ব-রক্ষকের সাথে তার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এক বছরের মধ্যে শত্রুপক্ষ যদি অশ্বটিকে হত্যা বা বন্দী করতে না পারেন, তখন একে রাজ্যে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর অশ্বসহ অন্যান্য প্রাণীকে খাবার খাওয়ানো হয় ও পরে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং যজ্ঞ শেষে রাজাকে অধিকৃত অঞ্চলসমূহের "চক্রবর্তী সম্রাট" হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ (কল্পিত চিত্র)

মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে বর্ণিত অশ্বমেধ যজ্ঞ সবচেয়ে পরিচিত পাঠ্য। কৃষ্ণ এবং ব্যাস সম্রাট যুধিষ্ঠিরকে এই যজ্ঞ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এছাড়াও দশরথ, পরীক্ষিত, জন্মেজয় অশ্বমেধযজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন।

বিগত শহস্র বছরের মাঝে মাত্র দুজন প্রাচীন শাসক এই যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন বলে নথিভুক্ত করা হয়। ১৭৪১ সালে দ্বিতীয়টি জয়পুরের মহারাজা জয় সিং এই যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন।

ব্যুৎপত্তি

“মেধ” শব্দের অন্যতম অর্থ হচ্ছে “যজ্ঞ”। বৈদিক সংস্কৃত ধাতুপাঠ অনুযায়ী মেধৃ ধাতুর ‘মেধা সংগমন য়োর্হিংসায়াং চ’ এই ধাতু পাঠ অনুযায়ী মেধার তিনটি অর্থ হয়- শুদ্ধবুদ্ধি বৃদ্ধি করা, লোকদের মধ্যে একতা ও প্রেম বৃদ্ধি করা এবং হিংসা। অরবিন্দ ঘোষও উক্ত অর্থে মত দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, "অশ্ব" বা ঘোড়া হলো শক্তির প্রতীক, যে সার্বজনীন কার্যক্রম চালায়।[1]

শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, অশ্ব শব্দ বীর্যবাচক, দেশবোসীর শৌর্য-বীর্য বৃদ্ধি করা এবং রাষ্ট্রকে সম্যক্ পরিচালনা করা অশ্বমেধ শব্দের অভিপ্রায়।[2]

দয়ানন্দ সরস্বতীর মতে, "অশ্বমেধ" এর তিনটি অর্থ, যথা: একজন রাজার ন্যায়পরায়ণ ও ন্যায়সঙ্গতভাবে তার প্রজাদের শাসন করা, একজন বিদ্বান ব্যক্তির মানুষকে বিনামূল্যে জ্ঞানের উপহার দেয়া এবং বায়ু দূষণ মুক্ত রাখার জন্য ঘি এবং গন্ধযুক্ত ও পুষ্টিকর পদার্থ আগুনে পোড়ানো।[3]

সুভাষ কাকের মতে, "অশ্ব" অর্থ সূর্য আর "অশ্বমেধ" হলো সূর্যের বার্ষিক নবায়নের যজ্ঞ, নববর্ষে এবং রাজার শাসন পুনর্নবীকরণ এর সহগামী। আধ্যাত্মিক স্তরে, এটি অভ্যন্তরীণ সূর্যের সাথে পুনরায় যুক্ত হওয়ার একটি উদযাপন।[4]

স্বামী পূর্নচৈতন্যর মতে, বৈদিক সংস্কৃত ও ধ্রুপদী সংস্কৃত আলাদা হওয়ায় ধ্রুপদী সংস্কৃতে "অশ্ব" হলো ঘোড়া আর বৈদিক সংস্কৃতে "অশ্ব" এর দুটি অর্থ, যথা: আত্মা ও রাষ্ট্র।[5]

অন্যদিকে, রাল্ফ টি.এইচ. গ্রিফিথ সায়ণ ভাষ্যে অনুকরণে মতে দিয়েছেন, "অশ্ব" হলো "ঘোড়া" ও "মেধ" হলো "বলিদান"। মনির-উইলিয়ামস্ সংস্কৃত অভিধানেও উক্ত অর্থ পাওয়া যায়।[6]

বর্ণনা

রামায়ণের পুথিচিত্র, শিল্পী সাহিব দিন, ১৬৫২। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে কৌশল্যা ঘোড়া বধ করে (বামে) তার পাশে শুয়ে আছেন (ডানে)। (কল্পিত চিত্র)

বাল্মিকী রামায়নে অশ্বমেধ যজ্ঞের বর্ণনা দেখা যায়। রাজা দশরথ পুত্রপ্রাপ্তির কামনায় এক অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। উক্ত বর্ণনায় রাজা যজ্ঞে আগত সকল সৎ এবং উপযুক্ত ব্যাক্তিকে দান ও ভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন। যজ্ঞে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য, শুদ্র -চারি বর্ণের বহু ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে অনেকেই বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন, এবং শত শত প্রাণী, এবং প্রতিটি পর্যায়ে অনেকগুলি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত আচার-অনুষ্ঠান ছিলো। (কিছু অনুবাদক অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করেন নি।[7][8][9] অন্যদিকে, কিছু অনুবাদক অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন যেখানে যজ্ঞের এক পর্যায়ে ঘোড়ার সাথে রাণী কৌশল্যা মিলিত হন, পরে ঘোড়া বধ করা হয় এবং অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়।[10][11])

মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে দেখা যায়, ব্যাসদেবের পরামর্শে রাজা যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেন। অশ্বমেধ যজ্ঞে রাষ্ট্রের প্রগতি ও প্রজাগণের উন্নতির জন্য রাজা বহু দান-দক্ষিণা করেন এবং রাজ্য প্রসারের জন্য যজ্ঞনিয়ম অনুসারে একটি বলবান অশ্বকে পৃথিবী ভ্রমণের জন্য মুক্ত করা হয়। অশ্ব যে যে স্থানে গমন করে, যজ্ঞকারী সেই স্থান অধিকার করেন। অশ্বকে কোনো নরপতি আটক করলে অশ্ব-রক্ষকের সাথে তার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুধিষ্ঠিরের সেই যজ্ঞের অশ্বকে রক্ষার জন্য অর্জুন নিযুক্ত হয়েছিলেন। অর্জুন পৃথিবীজয়ের পর হস্তিনাপুরে ফিরে আসলে অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু হয়। (কিছু অনুবাদক মহাভারতের অশ্বমেধিক পর্বে যজ্ঞ শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করেননি।[12][13] অন্যদিকে, কিছু অনুবাদক অশ্বমেধিক পর্বে যজ্ঞ শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন যেখানে যজ্ঞে ঘোড়া বধ করা হয়।[14][15][16])

অশ্বমেধ যজ্ঞে অশ্ব বধ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মহাভারতের অশ্বমেধিক পর্বেই যজ্ঞে পশু হত্যার বিরোধিতা দেখা যায়।[17] যজ্ঞে বলি নিয়ে একটি উপাখ্যানে বলা হয়েছে, দেবরাজ ইন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞে বলির সময় উপস্থিত হলে মহর্ষিদের মাঝে শাস্ত্রবিহিত কর্ম নির্ণয়ে বাদানুবাদ শুরু হয়। মহর্ষিগণ বলির পরিবর্তে ত্রৈবার্ষিক বীজ দ্বারা যজ্ঞ সম্পন্ন করা শাস্ত্রানুসারে সনাতন ধর্ম বিহিত কর্ম বলে সিদ্ধান্ত দেন।[18]

শান্তিপর্বে একটি বর্ণনায় উল্লেখ পাওয়া যায়, মহারাজ উপরিচর তার অশ্বমেধ যজ্ঞে হত্যার পরিবর্তে অরণ্যসম্ভূত বস্তু (ধান্য) দ্বারা যজ্ঞ পরিচালনা করেছিলেন।[19] এ পর্বে আরও দেখা যায়, দেবতা ও দেবর্ষিগণের মধ্যে "অজা" এর যাজ্ঞিক অর্থ নিয়ে মতভেদ হয়। দেবতারা এর অর্থ বলেন "ছাগল", কিন্তু দেবর্ষিগণের মতে এর অর্থ হচ্ছে "খাদ্যশস্য", কোনো পশু নয়। কারণ, যজ্ঞে পশু হত্যা করা সৎপুরুষদের ধর্ম নয়।[20][21]

বেদের সায়ণ, মহীধর ও উব্বট ভাষ্যেও অশ্ব বধ এবং রাণীকে মৃত অশ্বের সাথে মিলিত হওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়।[22][23][24] দয়ানন্দ সরস্বতী তার ঋগ্বেদীয়ভাষ্য ভূমিকায় উক্ত ভাষ্যকারদের মতসমূহের বিরোধিতা করেছেন। তার মতে সেখানে অশ্ব বধ এবং রাণীকে মিলিত হওয়ার কথা বলা হয়নি।[25]

চারবেদের অনেক মন্ত্রে অশ্ব হত্যার নিষেধ পাওয়া যায়।[26][27][28] যেমন, অথর্ববেদে বলা হয়েছে,

রাজসূয়, বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম এইসব যজ্ঞ অধ্বর অর্থাৎ হিংষারহিত। অর্ক এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রভূর মধ্যে স্থিত, যাহা জীবের বৃদ্ধিকারী এবং অত্যন্ত হর্ষদায়ক।[টিকা 1]

অথর্ববেদ, ১১।৭।৭ (শৌনক শাখা)

শতপথ ব্রাহ্মণের বর্ণনা অনুযায়ী, রাজাকে অশ্ব এবং প্রজা হচ্ছে অশ্ব ব্যতীত অপরাপর পশুর নাম। রাজ্যপালন এবং রাজ্যের উন্নতির জন্য কর্ম (যেমন: কর ধার্য করা)-কে বলা হয় অশ্বমেধ।[30][টিকা 2] অশ্ব হচ্ছে রাজ্যের প্রতিকী নাম। রাজা কর্তৃক রাজ্যের উন্নতির জন্য যে যজ্ঞ করা হয়, তাই অশ্বমেধ যজ্ঞ। আর রাজার স্ত্রীগণ রাজ্য পালনের জন্য সন্তানদের শিক্ষা প্রদান করে তাদের আত্মা ও শরীরের বল বৃদ্ধি করবেন এবং গর্ভস্বরূপ প্রজাসভায় পুত্ররূপ প্রজাকে সুখপ্রাপ্তির ইচ্ছা করবেন।

টিকা

  1. অথর্ববেদ, ভাষ্যকার ড. তুলশিরাম শর্মা: Rajasuya, Vajapeya, Agnishtoma, the yajna of love and non-violence, Arka, the songs in adoration of Agni and Surya, Ashvamedha, the yajna in adoration of the social order, Jivabarhi, the yajna in adoration of life, and the most ecstatic songs and yajnic performances abide and subsist in Brahma that breathes without breath (Rgveda, 10, 129, 2) even when the fires are out and the music is silent.[29]
  2. "রাষ্টং বৈ অশ্ব মেধঃ । অগ্ন হি গৌঃ ।অগ্নির্বা অশ্বঃ আজ্যং মেধঃ ॥ -শতপথ ব্রাহ্মন ১৩।১।৬।৩ অনুবাদ- অশ্ব হল রাষ্ট্রের প্রতীকি নাম(সুপ্রশাসকের প্রগতিশীল রাষ্ট্র অশ্বের ন্যয় বেগবান এই অর্থে)। এই রাষ্ট্রের মেধ(প্রগতি) কামনায় যে যজ্ঞ রাজা করেন তাই অশ্বমেধ যজ্ঞ।

তথ্যসূত্র

  1. "(PDF) The Historical and Philosophical Exegesis on Yagya in Ancient India"ResearchGate (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-০২
  2. শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩।১।৬১
  3. সত্যার্থ প্রকাশ
  4. Subhash Kak। The Asvamedha The Rite And Its Logic Subhash Kak
  5. "Animal Sacrifice in the Vedas? - Swami Purnachaitanya"https://www.swamipurnachaitanya.com/ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-০২ |ওয়েবসাইট= এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)
  6. Griffith, Ralph T. H. (Ralph Thomas Hotchkin) (১৯৮৭)। The texts of the White Yajurveda। Harvard University। New Delhi : Munshiram Manoharlal Publishers।
  7. Prof P P S Sastri। Valmiki Ramayana
  8. "Ramayana"INDIAN CULTURE (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-০৪
  9. Bhattacharjya, Ashutosh (১৯৪০)। Krittibasi Ramayan
  10. পঞ্চানন তর্করত্ন (১৯০৮)। বাল্মিকী রামায়ন, সংস্করণ ৪। বালকাণ্ড, ১২-১৪ সর্গ।
  11. Valmiki (18 মার্চ, 2008)। The Rámáyan of Válmíki, translated into English verse। Griffith, Ralph T. H. (Ralph Thomas Hotchkin) কর্তৃক অনূদিত। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  12. C.Rajagopalachari। Mahabharata
  13. Kamala Subramaniam। Mahabharata Kamala Subramaniam
  14. মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব, অধ্যায় ৭১-৭৩; ৮৮
  15. English Translation by K M Ganguli। The Mahabharata of Krishna-Dwaipayana Vyasa (English ভাষায়)।
  16. The Mahabharata of Krishna-Dwaipayana vyasa। Datta Bose, Calcutta। ২০১৯-০২-১৫।
  17. মহাভারত শান্তিপর্ব, অধ্যায় ২৬৩
  18. মহাভারত। অশ্বমেধ পর্ব। অধ্যায় ৯১
  19. মহাভারত শান্তিপর্ব ৩৩৭; ৩৩৮
  20. Varadpande, Manohar Laxman (২০০৯)। Mythology of Vishnu and His Incarnations (ইংরেজি ভাষায়)। Gyan Publishing House। আইএসবিএন 978-81-212-1016-4।
  21. Dutt, manmatha Nath (১৯০৩)। The Mahabharata Shanti Parva
  22. যজুর্বেদ মহীধর ভাষ্য ২৩।১৯-৩১
  23. ঋগ্বেদ সায়ণ ভাষ্য ১।১২৬।১১; ১।১৬২, ১৬৩সুক্ত
  24. যজুর্বেদ সায়ণ ভাষ্য অধ্যায় ২৫
  25. ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা – দয়ানন্দ সরস্বতী, অধ্যায়- ভাষ্যপ্রকরণশঙ্কাসমাধানাদিবিষয়ঃ
  26. অথর্ববেদ ৮।৩।১৫; ১।১৬।৪; ১০।১।২৯; ১১।৭।৭
  27. যজুর্বেদ ১৩।৪৮; ২২।৫;
  28. শতপথ ব্রাহ্মণ ৭।৫।২।৩৩
  29. English translation by - Dr. Tulsi Ram M.A., Ph.D. (London, U.K.), (Professor, Administrator, Researcher and Writer)
  30. শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩।২।২।১৪,১৫,১৭,১৯
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.