অর্ধপরিবাহী

অর্ধপরিবাহী (ইংরেজি: Semiconductor) এক বিশেষ ধরনের পদার্থ, যাদের তড়িৎ পরিবাহিতা পরিবাহী (ইংরেজি: Conductor) এবং অন্তরকের (ইংরেজি: Insulator) মাঝামাঝি। সিলিকন, জার্মেনিয়াম, ক্যাডমিয়াম সালফাইড, গ্যালিয়াম আর্সেনাইড ইত্যাদি অর্ধপরিবাহী পদার্থের উদাহরণ। কোন পদার্থ কতটুকু তড়িৎ পরিবহন করতে সক্ষম তা তাদের আপেক্ষিক রোধের মানের ওপর নির্ভর করে। যার আপেক্ষিক রোধ যত বেশি তার পরিবাহিতা তত কম। যেমন, স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কাচের (অন্তরক) আপেক্ষিক রোধ ১০১৬ ওহম-মিটার আর তামার (পরিবাহী) হলো ১০−৮। অর্ধপরিবাহীর আপেক্ষিক রোধের গড় মান এদের মাঝামাঝি (সাধারণত ১০−৫ থেকে ১০ এর মধ্যে)।[1]

আধুনিক যুগে প্রযুক্তির প্রভূত অগ্রগতির মূলে রয়েছে এই অর্ধপরিবাহী। কারণ এটি দিয়েই প্রথমে ডায়োড এবং পরবর্তীতে ট্রানজিস্টর নির্মীত হয়। আর এদের হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয় আধুনিক ইলেকট্রনিক্স যুগের। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলে এর বিশাল ভূমিকা রয়েছে। আর বিজ্ঞানের যে শাখায় এ নিয়ে আলোচনা করা হয় তা হল কঠিন অবস্থা পদার্থবিজ্ঞান (সলিড স্টেট)। অর্ধপরিবাহীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একে উত্তপ্ত করা হলে তড়িৎ পরিবাহিতা বৃদ্ধি পায়। তাই উচ্চ তাপমাত্রায় এটি সুপরিবাহীর মত আচরণ করে। অথচ সুপরিবাহীকে উত্তপ্ত করলে তার পরিবাহিতা কমে যায়। এর সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোন বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীর সাথে নির্দিষ্ট কোনো অপদ্রব্যের খুব সামান্য পরিমাণ (এক কোটি ভাগে এক ভাগ[2]) যোগ করলে তার রোধ অনেকগুণ কমে যায়, ফলতই পরিবাহিতা বেড়ে যায় অনেকগুণ। এভাবে অপদ্রব্য মেশানোর প্রক্রিয়াকে বলে ডোপায়ন। এই ডোপায়নের মাধ্যমেই ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নির্মাণ করা হয়।

গাঠনিক বৈশিষ্ট্য

সিলিকন পরমাণুর সর্ববহিঃস্থ স্তরে ইলেকট্রনের সমযোজী বন্ধন। কালো বৃত্তগুলো ইলেকট্রন, নীলগুলো পরমাণুর কেন্দ্রিন এবং বাঁকা রেখাগুলো দ্বারা বন্ধন বোঝানো হয়েছে

অর্ধপরিবাহীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, পরিবাহী পদার্থে যেখানে তাপমাত্রা বাড়ালে পরিবাহিতা হ্রাস পায় অর্ধপরিবাহীর ক্ষেত্রে সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবাহিতা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় সামান্য অপদ্রব্য যোগ করলে এদের পরিবাহিতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি ডোপায়ন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যাখ্যা করা হবে। এখানে অর্ধপরিবাহীর অভ্যন্তরীণ গঠন ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে প্রথম বৈশিষ্ট্যটি বিস্তারিত বলা হবে।

পরিবাহী পদার্থের সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে একটি, দুটি বা সর্বোচ্চ তিনটি ইলেকট্রন থাকে। বহিঃস্তরের এই ইলেকট্রনগুলো পরমাণু কেন্দ্রের সাথে বেশ দুর্বলভাবে সংযুক্ত থাকে। এই সর্ববহিঃস্থ তথা যোজন স্তরের ইলেকট্রনগুলো অন্য পরমাণুর অসম্পূর্ণ কক্ষপথ পূর্ণ করার জন্য নিজ পরমাণু ছেড়ে চলে যায়। এভাবে আয়নিক বন্ধন গঠিত হয়। এভাবে পরিবাহীর অভ্যন্তরের ইলেকট্রনগুলো এক পরমাণু থেকে আরেক পরমাণুতে ভ্রমণ করতে পারে। আর এ কারণেই এদের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, ইলেকট্রনের প্রবাহই তো আসলে বিদ্যুৎ। মূলত যোজন ইলেকট্রনের স্বাধীন চলাচলেই পরিবহন ঘটে। কিন্তু, অপরিবাহী পদার্থের সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তর ইলেকট্রন দ্বারা প্রায় পূর্ণ থাকে। উল্লেখ্য, বহিঃস্থ স্তরে আটটি ইলেকট্রন থাকলে তা সুস্থিতি লাভ করে; আর অপরিবাহীতে আটটি বা এর কাছাকাছি সংখ্যক ইলেকট্রন থাকে। তাই এদের যোজন ইলেকট্রন পরিবহনে অংশ নিতে পারেনা, তারা নিজ নিজ পরমাণুতে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে।

অপরদিকে অর্ধপরিবাহী পদার্থ যেমন জার্মেনিয়াম বা সিলিকন পরমাণুর বাইরের কক্ষে চারটি ইলেকট্রন থাকে। আটটি পূর্ণ করতে হলে তার প্রয়োজন আরও চারটি ইলেকট্রন। তারা বাকি চারটি ইলেকট্রন অর্জন করে আশেপাশের অন্য পরমাণু থেকে। তবে পাশের পরমাণু তাদের ইলেকট্রন একেবারে দিয়ে দেয়না বরং ভাগাভাগি করে। একে অপরের চারটি করে পরমাণু ভাগাভাগি করে। ফলে দুজনেই বহিঃস্থ কক্ষে আটটি করে ইলেকট্রন পায় এবং স্থিতি অর্জন করে। এভাবে তাদের মধ্যে যে বন্ধনের সৃষ্টি হয় তাকে বলে সমযোজী বন্ধন। উল্লেখ্য কিছু পরিবাহী বা অপরিবাহীও সমযোজী বন্ধন তৈরি করতে পারে। এভাবে সমযোজী বন্ধন গঠনের মাধ্যমে জার্মেনিয়াম বা সিলিকন বিশুদ্ধ কেলাস তৈরি করে যাকে কঠিন অবস্থা পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় অন্তর্জাত (intrinsic) কেলাস বলা হয়। এগুলোতে কোন মুক্ত ইলেকট্রন থাকেনা তাই স্বাভাবিক অবস্থায় এরা কোনো তড়িৎ পরিবহন করেনা। এ ধরনের বিশুদ্ধ কেলাসের তাপমাত্রা বাড়ালে কিছু কিছু সমযোজী বন্ধন ভেঙে যায় এবং গুটিকতক মুক্ত ইলেকট্রনের সৃষ্টি হয়। এভাবেই উচ্চ তাপমাত্রায় অর্ধপরিবাহী পদার্থ সাধারণ পরিবাহীর মত আচরণ করে।

শক্তি ব্যান্ড এবং বৈদ্যুতিক প্রবাহ

সর্বোত্তম স্ফটিকাকার অর্ধপরিবাহীতে, ইলেকট্রন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ব্যান্ডের মধ্যে শক্তি ধারণ করতে পারে। শক্তিগতভাবে, এই ব্যান্ডের অবস্থান পদার্থের মধ্যে শক্তভাবে যুক্ত ইলেকট্রন এবং মুক্ত ইলেকট্রন শক্তির মাঝামাঝি। শক্তি ব্যান্ডের এক একটি উপাদান পৃথকভাবে স্বতন্ত্র কোয়ান্টাম রাজ্যের অনেকগুলো ইলেকট্রনের সাথে মিলে যায় এবং কম শক্তি সম্পন্ন স্তর (নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি অবস্থিত) গুলো থেকে যোজ্যতা ব্যান্ড পর্যন্ত দখল শক্তি দখল করে নেয়। অর্ধপরিবাহী থেকে কুপরিবাহীগুলো থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা কারণ কোনো ধাতুর মধ্যে যোজ্যতা ব্যান্ড স্বাভাবিক কার্যকর অবস্থার ইলেকট্রন দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে যেখানে খুব কম সংখ্যক অর্ধপরিবাহী আছে যাদের পরিবহন ব্যান্ডে ইলেকট্রন পাওয়া যায় যা যোজ্যতা ব্যান্ডের উপরে।

কতটা স্বচ্ছন্দে সঙ্গে যা অর্ধপরিবাহীর যোজ্যতা ব্যান্ড থেকে পরিবহন ব্যান্ডে উত্তেজিত করা যাবে তা মূলত ব্যান্ডের মধ্যে ব্যান্ড ফাঁক (ব্যান্ড গ্যাপ) এর উপর নির্ভর করে। যথেচ্ছ ভাবে বিভাজিত সেমি কন্ডাক্টর এবং কুপরিবাহীর লাইন এর মধ্যে শক্তি ব্যান্ড ফাঁক প্রায় 2-3 eV এর মতো।[3]

সমযোজী বন্ধনের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনগুলো প্রতিবেশী বন্ধনের আশায় ঘুরতে থাকে। পাউলির বর্জন নীতির জন্য ইলেকট্রনের প্রয়োজন নিজ স্তর থেকে উচ্চতর বিরোধী স্তরে পৌঁছানো। যেমন এক মাত্রার জন্য একটি ছোট তারে, প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট শক্তির জন্য একটা অবস্থা আছে যার জন্য ইলেকট্রন এক দিক প্রবাহিত হতে দেখা যায় অন্য অবস্থার জন্য ইলেকট্রন অন্য দিকে প্রবাহিত হয়। একটি নেট বর্তমান প্রবাহের জন্য, এক দিকের দিকবিন্যাস অন্য দিকের থেকে বেশি হতে হয়। এটি সম্পাদনের জন্য অর্ধপরিবাহী পরবর্তী উচ্চতর অবস্থা ব্যান্ড ফাঁক শক্তি উপরে থাকা প্রয়োজন হয়। প্রায়ই এটি এটা বলা হয় যে: সম্পূর্ণ ব্যান্ডের ত্বরিত প্রবাহ অবদান রাখে না। তবে, যেহেতু একটি অর্ধপরিবাহী তাপমাত্রা পরম শূন্য উপরে উঠানো হয়, সেহেতু অর্ধপরিবাহীর জাফরি ​​কম্পন এবং ইলেকট্রনের পরিবহন ব্যান্ডে উত্তেজিত করার মত যথেষ্ট শক্তি আছে। প্রবাহী ইলেকট্রনগুলোকে মুক্ত ইলেকট্রন বলে। উত্তেজিত ইলেকট্রনগুলো পরিবহন ব্যান্ড এর পিছনে গর্ত (hole) ছেড়ে আসে। গর্ত (hole) নিজেদের নড়াচড়া করবেন না, কিন্তু একটি প্রতিবেশী ইলেকট্রন থেকে গর্ত ভরাট স্থানান্তর করতে এগিয়ে আসে। গর্ত (hole) এভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরে আসে এবং এদের আচরণ ধনাত্মক আধানের মতো। এক কঠিনের মধ্যে প্রতিবেশী পরমাণুর মধ্যে সমযোজী বন্ড হল পরমাণু একক ইলেকট্রনের বাঁধাই চেয়ে দশগুণ শক্তিশালী, তাই ইলেক্ট্রন মুক্ত স্ফটিক কাঠামো ধ্বংস পরোক্ষভাবে প্রকাশ করা হয় না।

তথ্যসূত্র

  1. উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান - (দ্বিতীয় পত্র) - ড. আমির হোসেন খান, মোহাম্মদ ইস্‌হাক। পঞ্চম সংস্করণ: জুলাই ২০০৪; অধ্যায় - ইলেকট্রনিক্স, পৃষ্ঠা: ৫৪৮
  2. Electronic Devices and Circuit Theory - রবার্ট এল বয়েলস্টেড এবং লুই ন্যাশেল্‌স্কি; প্রিন্টাইস এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল, নবম সংস্করণ; পৃষ্ঠা ৭, অনুচ্ছেদ - ১.৫
  3. "[Solved] The energy band gap for semiconductors is in the range of-"Testbook। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৪-৩০
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.