অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞান

অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞান (ইংরেজি Internal medicine) বলতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বিশেষায়িত শাখাকে বোঝায় যেখানে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের দেহের অভ্যন্তরের বিভিন্ন তীব্র, দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল রোগ প্রতিরোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদান করা হয়, যে রোগগুলির জন্য কোনও শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন নেই।[1] অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের শল্যচিকিৎসা ব্যতীত অন্যান্য সাধারণ বা বিশেষায়িত চিকিৎসাগুলিকে সাধারণভাবে অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞানের আওতাধীন ধরা হয়। অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞানে একজন রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করা হয়, নির্দিষ্ট কোনও অঙ্গ বা তন্ত্র নিয়ে বিশেষায়িত আলোচনা করা হয় না। হাসপাতালে কর্মরত অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের অন্তররোগ বিশেষজ্ঞ (ইংরেজি ভাষায় Internist "ইন্টার্নিস্ট" বা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিতে Physician "ফিজিশিয়ান") নামে ডাকা হয়।

রোগী ও চিকিৎসক

একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির যদি কোনও স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে তিনি পারিবারিক চিকিৎসক ব্যতীত প্রথম যে চিকিৎসকের কাছে সাক্ষাতে আসতে পারেন, তিনি হলেন একজন অন্তররোগ বিশেষজ্ঞ। একজন অন্তররোগ বিশেষজ্ঞ প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে উদ্ভূত হতে পারে, এরকম প্রায় সমস্ত রোগ বা স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণ লাভ করেন। তারা ছোটখাটো সমস্যা যেমন সাইনাস সংক্রমণ বা ভাঙা কবজি যেমন সারাতে পারেন, তেমনি গুরুতর সমস্যা যেমন বহুমূত্র রোগ (ডায়াবেটিস), সংক্রমণ, অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ইত্যাদি সমস্যারও চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার নজরদারি করতে পারেন।[2] একজন অন্তররোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন, দীর্ঘস্থায়ী রোগের উপরে নজরদারি করেন, ব্যবস্থাপত্র লেখেন, পরীক্ষাগারে চিকিৎসা পরীক্ষার অনুমতি দেন ও পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করেন এবং রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসা ইতিহাস লিপিবদ্ধ ও পর্যালোচনা করেন।

অন্তররোগ বিশেষজ্ঞরা সাধারণ চিকিৎসকদের (General practitioner) তথা পারিবারিক চিকিৎসকদের (family doctor) চেয়ে ভিন্ন, যদিও উভয় ধরনের চিকিৎসককেই প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক হিসেবে গণ্য করা হয়। পারিবারিক বা সাধারণ চিকিৎসকেরা শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক, বৃদ্ধ তথা সব বয়সের ও লিঙ্গের রোগীদের চিকিৎসা করতে পারেন, এর বিপরীতে অন্তররোগ বিশেষজ্ঞরা কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের চিকিৎসা করেন। যদিও সাধারণ চিকিৎসক ও অন্তররোগ বিশেষজ্ঞদের কাজের দায়িত্ব ও পরিধি অনেকখানিই একই রকম, তাদের মধ্যে আরেকটি বড়ো পার্থক্য হল এই যে অধিকাংশ অন্তররোগ বিশেষজ্ঞ বড়ো হাসপাতালে কাজ করেন, অন্যদিকে পারিবারিক বা সাধারণ চিকিৎসকেরা সাধারণত বহির্বিভাগীয় চিকিৎসালয়ে (আউটপেশেন্ট ক্লিনিক বা ক্লিনিক) বা ডাক্তারখানায় সেবা প্রদান করেন। এছাড়া প্রশিক্ষণ নেবার সময় অন্তররোগ বিশেষজ্ঞরা তুলনামূলকভাবে হাসপাতালের ভর্তি হওয়া অন্তর্বিভাগীয় রোগীদের জরুরি সেবা, সংকটকালীন সেবা ও বিশেষায়িত চিকিৎসেবা নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন, এবং এর বিপরীতে পারিবারিক বা সাধারণ চিকিৎসকেরা শিশুরোগ, বহির্বিভাগীয় চিকিৎসা এবং স্ত্রীরোগ/ধাত্রীবিদ্যা বিষয়ে বেশি সময় নিয়ে প্রশিক্ষণ নেন।[3] কোনও পরিবার যদি এমন একজন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসকের সন্ধান করে, যিনি পরিবারের বড়-ছোট সবাইকে চিকিৎসা করতে পারেন, নিয়মিত পরীক্ষা (রুটিন চেক-আপ) ও প্রতিরোধমূলক সেবা প্রদান করেন, স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা ও পরামর্শ দান করেন, শিশুদের টিকার ব্যবস্থা করেন, তাহলে তাদেরকে একজন পারিবারিক চিকিৎসক বা সাধারণ চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাৎ করা বেশি মানানসই। অন্যদিকে যদি কোনও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা, রোগনির্ণয় করা এবং জটিল চিকিৎসার জন্য সঠিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রতি নির্দেশনার (রেফারাল) প্রয়োজন হয়, তাহলে তার একজন অন্তররোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করা বেশি পছন্দসই হতে পারে।

অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞানকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিশেষায়িত শাখা যেমন হৃৎবিজ্ঞান, চর্মবিজ্ঞান, পাকান্ত্রবিজ্ঞান, ইত্যাদির মাতৃশাখা হিসেবে গণ্য করা যায়। যেমন, ২০১৯ সালের পর থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক হবার পরে যুক্তরাজ্যে চিকিৎসা পেশায় আগ্রহী সবাইকে দুই বছরের ভিত্তি শিক্ষাক্রম (Foundation programme) সমাপ্ত করে নিবন্ধিত চিকিৎসক হিসেবে সনদলাভ করতে হয়। এরপরে যদি কোনও চিকিৎসক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনও বিশেষায়িত শাখাতে উন্নততর প্রশিক্ষণ লাভ করতে চান, তাহলে বাধ্যতামূলকভাবে তিন বছর অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রশিক্ষণ শিক্ষাক্রম (Internal Medicine Training programme) সমাপ্ত করতে হবে। এটি আগে "কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ" (Core training) নামে পরিচিত ছিল।[1] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও চার বছর চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়াশোনা শেষ করে তিন বছর হাতে কলমে "রেজিডেন্সি" (Residency) শিক্ষাক্রম শেষ করলে অন্তররোগ বিশেষজ্ঞ উপাধি অর্জন করা যায়। রেজিডেন্সি প্রশিক্ষণের সময় তারা প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন বিশেষায়িত রোগের উপরে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন যেমন হৃৎবিজ্ঞান, অন্তঃক্ষরা বিজ্ঞান, প্রশমনমূলক সেবা, ইত্যাদি।

১৭শ শতকে টমাস সাইডেনহ্যামের রোগ সম্পর্কিত তত্ত্ব থেকে অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞান ক্ষেত্রটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০শ শতকের আগে বিশেষ রোগভিত্তিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আগমনের আগ পর্যন্ত অন্তররোগ বিশেষজ্ঞরা রোগ নিরাময়ে তেমন কোনও উপকারে আসতেন না। বিশেষ বিশেষ রোগের চিকিৎসা সুলভ হতে শুরু করলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি পায় এবং বিশেষ অঙ্গ ও তন্ত্র সম্পর্কিত চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপশাখাগুলি সংজ্ঞায়িত হওয়া শুরু করে, এবং এই উন্নতির প্রেক্ষিতে অন্তররোগ চিকিৎসাবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

তথ্যসূত্র

  1. Jonathan Law; Elizabeth A. Martin, সম্পাদকগণ (২০২০), Concise Medical Dictionary (১০ সংস্করণ), Oxford University Press
  2. "Guide to Primary Care Practitioners (PCP), Family Doctors, and Internists"। Healthline.com।
  3. "Internal Medicine vs. Family Medicine: Diagnosing the Differences"। St. Georges' University, Grenada, West Indies। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০২১
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.